চালের দাম নিয়ে বর্তমান সরকারের একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল। বাস্তবে সরকার সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চালের দাম নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তবে সরকার ১০ টাকা দরে হতদরিদ্র মানুষকে চাল সরবরাহ করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ২০১৬ সালে। এই কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ পরিবারকে চাল দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয় তখন। প্রতি বছর মার্চ থেকে পরবর্তী পাঁচ মাস ৩০ কেজি করে এ চাল পাওয়ার কথা দরিদ্রদের। এর বাস্তবায়ন নিয়ে শুরু থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে। একটি সহযোগী দৈনিকের এক খবরে জানা যাচ্ছে, ইস্যু করা কার্ডের সাড়ে চার লাখই ভুয়া। এ জন্য যেসব নামধাম ও মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সঠিক নয়। অন্য দিকে, দরিদ্রদের বদলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা এ সাহায্য কর্মসূচির উপকার অন্যায়ভাবে গ্রহণ করার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে দেশের কয়েকটি উপজেলা থেকে ভুয়া কার্ডের খবর তুলে ধরা হয়। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার চারজাজুরিয়া গ্রামের পিয়াস নামের এক শ্রমিকের বিপরীতে একটি কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। কার্ডের নাম্বার ৫৫৩। ওই কার্ডের বিপরীতে দেয়া মোবাইল নাম্বারে ফোন করে পাওয়া গেল একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে। তার সাথে কথা বলে জানা যায় তার আত্মীয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ডিলারের কথা। এই ব্যাংক কর্মকর্তা ডিলার ব্যক্তিটির ফুফাতো ভাই। তাদের গ্রামের বাড়ি চৌহালীতে। গত দুই বছরেও তিনি নিজের এলাকায় যাননি বলে জানান। একই ইউনিয়নের অন্য একটি গ্রাম রেহাইকাউলিয়ার গোলাম মোস্তফার নামে আরেকটি কার্ড পাওয়া গেল। ওই কার্ডের বিপরীতে মোবাইল নাম্বারে ফোন করে জানা যায়, সেটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনুসন্ধানে শুধু একটি ইউনিয়নেই প্রবাসী সচ্ছল ও অস্তিত্বহীন প্রায় ১০০টি নাম পাওয়া গেছে।
বাস্তবে সরকারের ব্যাপকভাবে প্রচার করা এ কর্মসূচির দুর্নীতির চিত্রটি আরো অনেক বিস্তৃত। অসংখ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য অধিদফতর দুর্নীতি নিয়ে কিছুটা অনুসন্ধান চালিয়েছে। সরকারের অধীনে পরিচালিত তদন্তে চার লাখ ৫১ হাজার ১২৪টি ভুয়া কার্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কেবল একটি জেলা ময়মনসিংহেই ৫০ হাজার ৫০০ ভুয়া কার্ড পাওয়া যায়। সাধারণত সরকারি দলের স্থানীয় প্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজন এবং মৃত ব্যক্তির নামে ১০ টাকায় চাল পাওয়ার জন্য কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জানেন না এ কার্ড তাদের নামে ইস্যু হয়েছে। আবার এক গ্রুপ রয়েছে যাদের পরিবার সচ্ছল; কিন্তু বর্তমান ক্ষমতার সাথে বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে এ সুযোগ পাচ্ছে। সরকারি তরফে যে তদন্ত করা হয়েছে সেসব তদন্তে এ গ্রুপকে দেয়া কার্ডকে ‘ভুয়া’ হিসেবে উপস্থাপিত না করার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তারা মূলত শাসকদলের সুবিধাভোগী হিসেবে তা গ্রহণ করেছেন অন্যায়ভাবে। এদের নামধাম ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার ভুল নয়। সুতরাং এগুলো ভুয়া কার্ড হিসেবে ইস্যু হয়নি। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এমন কার্ডের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে।
প্রকৃত হতদরিদ্ররা বছরের পাঁচ মাস যদি ১০ টাকা দরে ৩০ কেজি চাল পায়, তাহলে বাংলাদেশে অনাহারী মানুষ থাকার কথা নয়। এমনকি, রাস্তাঘাটে ভিক্ষুকও কমে যাওয়ার কথা। বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশে অভাবী ও অনাহারী মানুষের সংখ্যা কেবল বাড়ছে। প্রকৃত অভাবীদের চিহ্নিত করতে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায়ে যারা কাজ করেন, তারা অভাবী মানুষের খবর জানেন ভালোভাবেই। কারা কারা ১০ টাকা দরের চাল পেতে পারেন, তার মানদ-ও ঠিক করা আছে। যারা নিয়মিত খাবার জোগাড় করতে পারছেন না, তারা এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় ডিলারদের একটি চক্র এবং ক্ষমতাসীন দলের অসৎ নেতারা গরিবের চাল লুটে নিচ্ছে। এ জন্য অনেক রাজনীতিক হাতেনাতে ধরাও খেয়েছেন। এ কর্মসূচি সফল করতে হলে সব দুর্নীতি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। লুটেরাদের শাস্তি দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। স্বচ্ছ তালিকা তৈরি করতে হবে অবশ্যই।
Leave a Reply