সরকারের ভার্চুয়ালের লৌহ-খাঁচা ভেঙে আজকের সভায় উপস্থিত ভাই-বোন, চাচা-চাচী, খালা-খালু, ফুপু-ফুপা, গ্রামবাসী, পাড়া-প্রতিবেশী। এক দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আজ মান্যবর কোভিড সাহেব বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়ে নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস প্রভৃতি দেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ এসব দেশ গর্ব করে বলেছিল, তারা তাদের দেশ থেকে কোভিড সাহেবের ছানাপোনাদেরও বিদায় করে দিয়েছেন। এই ধরনের অসম্মানজনক কথা বলায় কোভিড সাহেব খুবই মর্মাহত হয়েছেন এবং তাদের জানান দিতে যাচ্ছেন যে, কোভিড সাহেবকে বিদায় করার সাধ্য কারো নেই; তিনি ফের হাজির হয়ে শেষ কথা প্রমাণ করে দিতে চান।
সম্মানিত বন্ধু ও মুরুব্বিগণ
আপনারা অবগত আছেন, মান্যবর কোভিড সাহেব চীন থেকে গোটা ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার দেশে দেশে তার ভ্রমণ শুরু করেন গত বছর ডিসেম্বরের শেষ থেকে। শুরুতে তিনি বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ বন্ধুবৎসল দেশ সফরে আসতেই চাননি। কিন্তু তা কী করে হয়! তার বাংলাদেশ সফরে অনীহা আমাদের ইজ্জতের সওয়াল হয়ে দাঁড়াল। আমাদের সদাশয় সরকার কোভিড সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘আপনি আসুন। আপনার এই আগমনকে সর্বাঙ্গীণ সফল করে তোলার জন্য আমরা সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবো।’ হে মান্যবর, সরকার এত করে বলায় শেষ পর্যন্ত আপনি বাংলাদেশ সফরে রাজি হলেন।
কিন্তু চার্টার্ড প্লেনে করে আপনি বাংলাদেশে আসতে রাজি হলেন না। প্লেনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে আপনি বিদেশপ্রত্যাগত বাংলাদেশীদের সাথে ঢাকার বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু আপনার মতো সম্মানিত অতিথিকে তো কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন, তথা বিমানবন্দরের নিকটবর্তী আশকোনা হজ ক্যাম্পে আটকে রাখা যায় না। অতোটা অসভ্য আমরা নই। অতিথি আপ্যায়নে আমাদের রয়েছে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। ফলে আমরা আপনাকে প্রায় সাথে সাথেই প্রবাসীদের সাথে গ্রামে পাঠিয়ে দিলাম। সবুজে শ্যামলে, পুকুর নদীতে ভরা আমাদের গ্রামগুলো। আপনি যাতে অবাধে গ্রাম থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে পারেনÑ আমরা তার ব্যবস্থা করলাম। কোনো কোনো ছিদ্রান্বেষী, বিশেষ করে বিএনপির লোকেরা প্রশ্ন করতে শুরু করল, চেনা নেই জানা নেই এমন একজন অচেনা লোককে এভাবে সারা দেশে অবাধে ঘুরে বেড়াতে দিলে বিপদ হতে পারে। ‘এরা এরকমই’। সরকারের কোনো উন্নয়নই এরা সহ্য করতে পারে না। তখন আমাদের দিগি¦জয়ী, ফ্যাশন করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সাহেব বলে দিলেন, কোভিড সাহেবের যদি কোনো ক্ষতি করার শক্তি থাকে, তাহলে এ সরকার তারও ওপর শক্তিশালী। অতএব, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা সাধারণ নাগরিকরাও এ আশ্বাসে আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করলাম।
তবে মান্যবর কোভিড সাহেবের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। তাকে খালি চোখে দেখা যায় না। তিনি হাঁচি-কাশি-স্পর্শের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হন। ফলে তিনি ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন। তারপর থেকে তো ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এখন টেস্ট করলেই ২০ শতাংশের ওপর কোভিড রোগী। সারা দুনিয়ায় কোভিড সাহেবকে নিয়ে তোলপাড়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, কোভিড থেকে নিরাপদ থাকার জন্য চারটি কাজ করতে হবে। টেস্ট, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া আর একজন থেকে একজন কমপক্ষে তিন ফুট দূরে দাঁড়ানো এবং মুখে মাস্ক পরা। দুনিয়াজুড়ে এই কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। শুরু হলো ‘লকডাউন’। বন্ধ হলো অফিস, আদালত, শপিংমল, পর্যটনকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধÑ ঘরে থাকুন। সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। কাজকর্ম বন্ধ, উৎপাদন বন্ধ। শিক্ষা বন্ধ। কর্মহীন কোটি কোটি লোক। দিনমজুরদের না খেয়ে থাকার অবস্থা। বাংলাদেশে সরকার ত্রাণ দিতে চেষ্টা করল কর্মহারা দরিদ্র মানুষদের। কিন্তু তা লুটে খেলো ক্ষমতাসীন মহলের ঘনিষ্ঠ চোরেরা।
সরকার এই গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি খুলে দেয়, এই বন্ধ করে। এ রকম আগু-পিছু করতে করতে খুলে গেল গার্মেন্ট। বলা হলো, ‘কারখানা খুললেও সবাইকে সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। মাস্ক পরতে হবে।’ মাস্ক পরল অনেকেই, তবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা দুরূহ হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে খুলে দেয়া হলো দোকানপাট, হাট-বাজার। এখন সব খোলা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেনি। ভার্চুয়ালে তা চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। খুলে গেছে সব পর্যটনকেন্দ্র। অবরুদ্ধ মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে এসে এমন ছ্যাঁচা খাবেন, তা বোধ হয় ‘তিনি’ কল্পনাও করেননি। কোভিড সাহেব এ পর্যন্ত বিশ্বে দুই কোটি ৩৪ লাখ লোককে আক্রমণ করেছেন। তাতে মারা গেছেন আট লাখ ৯ হাজার লোক। বাংলাদেশে আক্রান্ত প্রায় তিন লাখ। মারা গেছেন প্রায় চার হাজার। আক্রমণের বিস্তার চলছে।
হে মহাত্মন!
আপনি হয়তো ভেবেছিলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আপনার শুভাগমনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, বা এখনো হচ্ছে, বাংলাদেশেও আপনার আগমনে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমাদের বাক্যবীর মন্ত্রী সাহেব তো শুরুতেই বলে দিয়েছেন, ‘আমরা আপনার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আপনি আমাদের টিকিটিরও নাগাল পাবেন না।’ সত্যি সত্যি নাগাল পাননি। কিন্তু আপনার শুভাগমনে আমরা আত্মবিশ্বাসে শত গুণ বলীয়ান হয়েছি। আমরা যে জাতি হিসেবে কত শক্তিশালী, আপনার আগমনে তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। হ্যাঁ, মৃত্যু কিছু হচ্ছে। প্রতিদিন ‘মাত্র’ আড়াই-তিন হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। আমেরিকার তুলনায় তা কিছু না। তাহলে নিঃসন্দেহে আপনিও স্বীকার করবেন যে, আমরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি। মৃত্যু কোনো ব্যাপার না। এমনিতেই তো কত মানুষ মারা যায়। বন্যায় মরে, সড়ক দুর্ঘটনায় মরে, পানিতে ডুবে মরে, বজ্রপাতে মরে। সে তুলনায় আপনার প্রভাবে গড়পরতা দৈনিক ৪০ জন মানুষের মৃত্যু আমরা গোনায় ধরি না। উপরন্তু আমাদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি স্বাস্থ্য খাতকে পুরো ঢেলে সাজিয়েছেন। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তিনি যাকে সামনে পেয়েছেন, তাকেই কোভিড পরীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন। তা থেকে বাদ যায়নি টাউট-বাটপার, চোর-ছ্যাঁচড়, প্রতারক-ভণ্ড কেউই। এমনকি বাদ যায়নি, রাজমিস্ত্রি কিংবা নির্মাণ কোম্পানি। এদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। মন্ত্রী এ সম্পর্কে হলফ করে বলেছেন, এসব চুরি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। সব জানে অধিদফতর। আমাদের সরকারের মাখনের মতো কোমল হৃদয়। ফলে শত কেলেঙ্কারির পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার স্বপদে বহাল আছেন। অথচ এর চেয়ে অনেক তুচ্ছ ও নগণ্য কারণে কোভিড মওসুমে বেশ কয়েক দেশের মন্ত্রী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মান্যবর কোভিড, আপনিও নিজ চোখে দেখে গেলেন, কত বিচিত্র আমাদের দেশ।
হে মহান সৃষ্টিশীল!
আমাদের একটা বদ-স্বভাব আছে। আর তা হলো, সব কিছুতেই অপরের দোষ ধরা। এই যেমন ধরুন, কিছু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানুষ গত ছয় মাস ধরে কেবল আপনার নিন্দাই করে গেছে। তারাই আবার বলছে, গেল গেল, সব গেল। দেশের কোটি কোটি লোক কোভিডের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মানুষের আয়-রোজগার কমেছে। বহু পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন দিন-এনে-দিন-খাওয়া মানুষ। কিন্তু না, আপনার মহতী উপস্থিতির কারণে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বহু পেশার বিকল্প ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন ধরুন, যে হকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ভ্যানে করে গেঞ্জি-আন্ডারওয়্যার বিক্রি করতেন, তিনি এখন মাস্ক-গ্লাভস বিক্রি করছেন। যে রিকশা-ভ্যানচালক শিশুদের স্কুলে নিয়ে যেতেন, তিনি এখন ওই একই রিকশা-ভ্যানে আচার-চানাচুর বিস্কুট চায়ের দোকান দিয়েছেন। কিন্তু হে মহামান্য, আপনি যদি বাংলাদেশ সফরে না আসতেন, তা হলে কি সাধারণ মানুষের এই সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটত, বলুন?
শুধু এই দরিদ্র মানুষেরাই যে, তাদের পেশার পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবিকার সংস্থান করছেন, তা নয়। বড় বড় লুটেরা নির্মাণ কোম্পানি কিংবা প্রতারক হাসপাতাল ও তাদের ব্যবসা পরিবর্তন করে নতুন ব্যবসাবাণিজ্যে যোগ দিয়েছেন। তাই লুটেরা নির্মাণ কোম্পানিগুলো আপনার আগমন সংবাদ পেয়েই রাতারাতি মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি সাপ্লাইয়ের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং কী আশ্চর্য, সরকার যেসব কোম্পানিকে প্রস্তাব করা মাত্র কাজ তো দিয়েছেই, সেই সাথে তাদের কোটি কোটি টাকা অগ্রিমও দিয়েছে, এসব কোম্পানি, নি¤œমানের ও স্বল্পসংখ্যক মাস্ক-পিপিই সাপ্লাই দিয়ে এদিক ওদিক টাকা ছড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, এসব ভণ্ড ভুয়া কোম্পানি মেডিক্যাল খাতে কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়া কিভাবে কাজ পেল? জবাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জরুরি পরিস্থিতিতে যে কাউকে কাজ দেয়া যায়। এতে দোষের কিছু হয়নি।’ কিন্তু আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে, ওসব লুটেরা কোম্পানি প্রায় সবাইকে ভালোভাবে তুষ্ট করে এ কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। মন্ত্রী এক কথার মানুষ। তার এক জবাব : ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’ আর সরকারও তার এ কথা মেনে নিয়েছে।
হে মান্যবর কোভিড!
আমাদের সরকার ধরে নিয়েছে, আপনি এই ‘দুর্জয় ঘাঁটিতে দাঁত বসাতে পারবেন না। আর তাই সব কিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষের জীবন বড়, সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবিকা না থাকলে জীবন চলবে কিভাবে? তাই গণপরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, কলকারখানা, পর্যটনকেন্দ্র সব খুলে দেয়া হয়েছে। ঈদে লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি করে ঘরে ফিরেছেন। কিন্তু আপনার উপস্থিতি যাতে বড় হয়ে না ওঠে, সে জন্য মানুষকে টেস্ট-বিমুখ করার নানা কায়দা-কানুন করা হয়েছে। প্রথমে আরোপ করা হয়েছে ফি। তারপর হাসপাতালে অন্য রোগ নিয়ে ভর্তি হতে চাইলে, কাজে যোগ দিতে চাইলে, বিমানে ভ্রমণ করতে চাইলে লাগবে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট। সেটি জোগাড় করা কঠিন করে তুলেছে সরকার। ফলে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে প্রসূতিসহ বহু মানুষের পথেঘাটে প্রাণ গেছে। আস্থা হারিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছে হাসপাতালবিমুখ। হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড খালি পড়ে আছে। নীরবে নিভৃতে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। আর দ্রুত বিস্তার ঘটছে আপনার বংশধরদের। কিন্তু সেসব হিসাবে ধরা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সামনে বিপদ। কিন্তু সরকার বলছে, ওরা বিশেষজ্ঞ নয়, ছিদ্রান্বেষী।’ অতএব হে মহান কোভিড বাংলাদেশ থেকে আপনার বিদায় আসন্ন। আর আপনি যদি স্বেচ্ছায় পেছনের দরজা দিয়ে বিদায় না নিতে চান, তবে আপনাকে দেয়া হবে ‘ক্রসফায়ারে’, নইলে চিরতরে গুম করে দেয়া হবে।
অতএব, হে মহামান্য কোভিড
সময় থাকতেই আপনি দৌড়ান। নইলে আপনার রেহাই নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
Leave a Reply