বৈশ্বিক করোনার থাবায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। এই ধীরগতি কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো স্বল্প পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, যমুনা সেতুতে ঝুঁকি থাকায় বিদ্যমান যমুনা সেতুর রেল চলাচল বন্ধ করতে ২০১৬ সালে সেতুর পাশেই আরেকটি রেল সেতু করার প্রকল্প নেওয়া হয়। বিভিন্ন কারণে কাজের গতি আসেনি। সমস্যা সমাধান করে গত মার্চে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। তখন বলা হয়, দ্রুতই এই সেতুর কাজ শুরু করা যাবে। কিন্তু করোনার কারণে এটি আর শুরু করা যায়নি। প্রকল্পের মোট ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে বড় অংশ দিচ্ছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এর কারিগরি ও ঠিকাদারি করবে তারা। করোনার কারণে কোনো কর্মকর্তাই দেশে আসতে পারছেন না, জাপান থেকে প্রয়োজনীয় মালামালও আনা যাচ্ছে না। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কাজের গতি কমে গেছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী নির্ভর প্রকল্পগুলোয়ও।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নয়নকাজে গতি কমেছেÑ এটা মানতে হবে। পরিস্থিতি খারাপ বলে কাজের গতি কমেছে। তবে করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আবার কাজে গতি আসবে বলে আশা করা যায়। তবে খুব শিগগির কাজে গতি আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, জাইকার অর্থায়নে বাংলাদেশে মেট্রো রেল, মাতারবাড়ীসহ মোট ৩১টি প্রকল্প চলমান রয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগের কাজ বন্ধ রয়েছে। মেট্রোসহ কয়েকটির কাজ চলছে সীমিত আকারে।
একই অবস্থা চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান দিয়ে সহায়তা করে আসছে চীন। এর মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন, রেলপথ, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে তাদের প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ইআরডি জানায়, চীনা অর্থায়নে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। চীনা ঋণের সুদ ও শর্ত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) চেয়ে অনেক কঠিন। সাধারণত চীন অর্থায়নে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২ শতাংশ সুদহার, যা সার্ভিস চার্জসহ পরিশোধ করতে হবে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা ফি ধরা হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ২৫ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়েছে ২০ বছর (৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ)। এ ছাড়া চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ফি পুরোটা পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চীনা অর্থায়নে অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন স্থাপন প্রকল্প একটি। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন দেবে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। করোনার প্রভাবে প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ আছে।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের মোট ব্যয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন দেবে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে এটি অনুমোদন পায়। চলতি বছরের জুন নাগাদ প্রকল্পকাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কর্মরত অনেক চীনা কর্মী বর্তমানে চীনে রয়েছেন, এ জন্য কাজে বিঘœ ঘটছে। তবে অগ্রাধিকার বিবেচনায় প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। এর ব্যয় ধরা হয় ১৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন দেবে ৫ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুন নাগাদ এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে আপাতত কাজ বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির এশিয়া উইংয়ের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানান, চীনা ঋণের শর্ত থাকে প্রকল্পে ঠিকাদার, জনবল ও প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি চীন থেকে আনতে হয়। এ জন্য দেশটির আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকা ও প্রকল্পের জনবল না এলে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব পড়বেই। কারণ শর্তের বাইরে আপাতত যাওয়ার সুযোগ নেই।
Leave a Reply