নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ করোনা আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে টানা ১৩ দিন বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালের (শেবাচিম) করোনা ইউনিটে ছিলেন গৃহবধূ তাসনিম রহমান। এ সময় একদিনও তার স্বামীকে দেখতে যাননি ডাক্তার। শারীরিক অবস্থার উন্নতি বা অবনতি জানাতে তাকেই যেতে হতো ডাক্তারদের কক্ষে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আকুতি জানাতে হতো ডাক্তারদের কাছে। সমস্যার কথা শুনে জানালার ফাঁক কিংবা দরজার ওপাশ থেকে ওষুধের নাম লিখে দিতেন ডাক্তার। পরে তা সংগ্রহ করে স্বামীকে খাওয়াতেন।
তাসনিম রহমান বলেন, ‘কেউ মারা গেলেই কেবল ওয়ার্ডে দেখা মিলত ডাক্তার। আপাদমস্তক সুরক্ষা সামগ্রীতে মুড়ে লাশের খানিকটা দূরে দাঁড়াতেন। আর রোগীকে পরীক্ষা করে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করতেন নার্স। এরপর মাথা হেলিয়ে মৃত ঘোষণা করে আবার চলে যেতেন নির্ধারিত কক্ষে।’ কেবল তাসনিম রহমানই নন, শেবাচিমের করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাছ থেকে প্রতিদিনই মিলছে এরকম বহু অভিযোগ। মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসক-নার্সদের কাছে না পাওয়া, অক্সিজেন পেতে ঘুষ দেয়া, অবজারভেশন রুমে একসঙ্গে করোনা পজিটিভ আর নেগেটিভ রোগীদের গাদাগাদি করে রাখা, নি¤œমানের খাবার সরবরাহ, রোগীর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হওয়ার অভিযোগও আছে। এসব অভিযোগ অবশ্য স্বীকার করেননি হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন। করোনা পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক-নার্সরা সেবা দিচ্ছেন বলে দাবি তার। অবজারভেশন কক্ষ বেহাল : করোনা উপসর্গ নিয়ে শেবাচিমের করোনা ইউনিটে সাতদিন ছিলেন বরিশালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিশ্বজিত ঘোষ। তার দেখাশোনা করতে প্রতিদিনই সেখানে যেতেন শ্যালক অখিল ঘোষ। তিনি বলেন, ‘নিচতলায় ৩টি অবজারভেশন রুম রয়েছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়াদের প্রথমে রাখা হয় এসব রুমে। এখানে থাকাবস্থায় করোনা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য নেয়া হতো নমুনা। কখনও কখনও চার থেকে পাঁচদিন লাগে রিপোর্ট আসতে। যে ৩ রুমে রোগীদের রাখা হয়, তার একটি হলরুমের মতো। সেখানে একসঙ্গে ৫০-৫৫ জন রোগী দেখেছি। বেডের পাশাপাশি মেঝেতেও রাখা হয় রোগী। পুরো হলরুমে মাত্র দুটি ফ্যান। তীব্র গরমে রোগীদের প্রচ- কষ্ট সহ্য করতে হয়। এদের সবাই যে করোনা পজিটিভ তা নয়, উপসর্গ থাকলেই একসঙ্গে রাখা হয় সেখানে। রোগীর অ্যাটেনডেন্টরাও থাকেন। গাদাগাদি করে রাখায় যাদের করোনা নেই, তারাও থাকেন সংক্রমণের ঝুঁকিতে।’ করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন পিরোজপুরের এক ব্যক্তি বলেন, ‘অবজারভেশন রুম হিসেবে আরও যে দুটি কক্ষ রয়েছে, সেখানে ফাঁকা ফাঁকাভাবে বসানো ৬টি করে বেড রয়েছে। কিন্তু ওই দুই কক্ষে জায়গা হয় কেবল প্রভাবশালীদের। সাধারণ রোগীরা ঠাঁই পান না সেখানে।’
লাশের সঙ্গে বসবাস : শুরু থেকেই শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা ইউনিটে ১৫০টি বেড বসানোর কথা বলে এসেছেন। কিন্তু সরেজমিন তা পাওয়া যায়নি। পজিটিভ হলে রোগীদের রাখা হয় দোতলা ও তিন তলায়। দোতলায় রয়েছে ৮টি কেবিন। রোগী ও তার স্বজনের জন্য ২টি করে বেড রয়েছে কেবিনে। দোতলার ওই কেবিনগুলোয় সরবরাহ লাইনে অক্সিজেন পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সিলিন্ডারের মাধ্যমে দেয়া হয় অক্সিজেন। ৩ তলায় রয়েছে ৩টি কেবিন আর দুটি সাধারণ কক্ষ। সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন পাওয়ার সুবিধা রয়েছ এখানে। সাধারণ কক্ষে ৮টি করে বেড। এসব বেডের মাঝে ম্যাট্রেস পেতে করা হয়েছে রোগীর স্বজনের থাকার ব্যবস্থা। অর্থাৎ এখানেও রয়েছে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা।
৩ তলার সাধারণ বেডে চিকিৎসা নেয়া শাকিল আহম্মেদ (৩৫) বলেন, ‘দিনে ২-৩ বার নার্স আসে ইনজেকশন দিতে। এছাড়া তাদের পাওয়া যেত না। ডাক্তারের দেখা পাইনি কখনও। তারা সব সময় থাকেন তাদের নির্ধারিত রুমে। প্রায় প্রতিদিনই ওয়ার্ডে দু-একজন মারা যান। আর সেই লাশ পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ২৪ জুন দুপুর সাড়ে ৩টায় মনোয়ারা বেগম নামে এক মহিলা মারা যান। তার স্বজনকে অসহায়ের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছি। কিন্তু লাশ সরানোর উদ্যোগ নেয়নি কেউ। ৪ ঘণ্টা পর সরানো হয় সেই লাশ। ওইদিন রাত ১২টায় শ্বাস উঠে ইদ্রিস হাওলাদার নামে এক রোগীর। ভোর ৫টায় মারা যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে আসেনি ডাক্তার-নার্স। সেই লাশটি সরাতেও সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা।
অক্সিজেন পেতে হলে দিতে হয় ঘুষ : শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে অক্সিজেন মিলবে- এই আশায় অনেকে হাসপাতালে ছুটে যান। কিন্তু অক্সিজেন পেতে ঘুষ দিতে হয় দায়িত্বরত করোনা ওয়ার্ড বয়দের। গৃহবধূ তাসনিম রহমান বলেন, ‘আমার স্বামীর অক্সিজেন লেভেল যখন ৭০’র নিচে, তখন অনেক চিৎকার করেও অক্সিজেন পাইনি। পরে একজন ওয়ার্ডবয়কে ৫শ’ টাকা দিতেই অক্সিজেন মিলে যায়। এরপর যতবার অক্সিজেনের সিলিন্ডার বদল করতে হয়েছে, ততবার ৫শ’ টাকা করে দিয়েছি।’ চিন্ময় দাস বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে অক্সিজেন মেলা করোনা ইউনিটের একটি ওপেন সিক্রেট ঘটনা। শেবাচিম পরিচালকের বক্তব্য : সবকিছু যে রোগীদের চাহিদা মতো হচ্ছে না, সেটা স্বীকার করলেও ডাক্তার-নার্সদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করেন শেবাচিম পরিচালক ডা. বাকির হোসেন। করোনা ইউনিটে ২ জন সহকারী অধ্যাপকের নেতৃত্বে মোট ৯ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ঠিক যে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি করোনা ইউনিটে একজন আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা দেয়ার। সেটা হয়ে গেলে এসব জটিলতা থাকবে না। এত রোগী আসবে, সেটা বুঝতে পারিনি। এটা ঠিক যে অবজারভেশন রুমে খানিকটা জটিলতা হচ্ছে। আমরা ৪ তলায় সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করার চেষ্টা করছি। এটা হয়ে গেলে ভিড় না বাড়িয়ে রোগী রাখতে পারব। তিনি বলেন, টেকনোলজিস্ট সংকটের কারণে নমুনা সংগ্রহে কিছু সমস্যা হয়। তবে সর্বোচ্চটা দিয়ে রোগীদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি।
Leave a Reply