মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশী রায়হান কবির কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় সাক্ষাৎকার দেয়ার ঘটনার পর দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এই মুহূর্তে সারা দেশই লকডাউন। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান। অভিযানে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, শ্রমিকদের সামান্য ত্রুটি পেলেই দোকানপাট বন্ধ করা ছাড়াও আটক করার ঘটনা ঘটছে বলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ দিকে মালয়েশিয়ান পুলিশের মহাপরিদর্শক তানশ্রি আবদুল হামিন বদর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশী নাগরিক রায়হান কবিরের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করেছে ইমিগ্রেশন বিভাগ। তাই তাকে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার আগে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হবে।
ইতোমধ্যে রায়হান কবিরকে মালয়েশিয়ায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড নাগরিক’ চিহ্নিত করে ধরিয়ে দিতে ইমিগ্রেশনের ফেসবুক পেইজে ছবি এবং পাসপোর্ট দিয়ে তাদের দেশের নাগরিকদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত পুলিশ বা ইমিগ্রেশন তাকে আটক করতে পারেনি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. শংকর চন্দ্র পোদ্দার নয়া দিগন্তকে আল জাজিরায় রায়হান কবিরের সাক্ষাৎকার দেয়া এবং পরবর্তী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে গতকাল সোমবার রাতে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশী যে কাউকে যেকোনো বিষয়ে বুঝেশুনে তারপর বক্তব্য দেয়া উচিত। আর যেহেতু ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তার ভিসা বাতিল করেছে সেহেতু আমি মনে করি দ্রুত নিয়মের মধ্যে তার সারেন্ডার করা উচিত।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক চলমান লকডাউনে বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী আচরণ করা হয়েছে বলে ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়া’স লকডাউন’ শিরোনামে ২৫ মিনিটের ডকুমেন্টারি সম্প্রতি আল-জাজিরা টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়। এই প্রতিবেদনটি প্রচার হওয়ার পর মালয়েশিয়া সরকার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবেদনটিকে ‘ভিত্তিহীন’ হিসাবে দাবি করছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশী নাগরিক রায়হান কবির সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই রায়হানের প্রতি ক্ষুব্ধ মালয়েশিয়া সরকার।
এ নিয়ে আলজাজিরা কর্তৃপক্ষকে নোটিশ পাঠানো হয়। আলজাজিরা টেলিভিশনকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারের বিষয়ে দেশটির অভিবাসন আইন ১৯৫৯/৬৩ এর ধারায় তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপর থেকেই মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। রায়হান কবিরের বিষয়ে গতকাল মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম না প্রকাশ করে বলছেন, ‘এ নিয়ে থউদ্বেগের কোনো কারণ নেই, কূটনৈতিক রীতিনীতির আওতায় যা করা দরকার দূতাবাস তা করবে’।
গতকাল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বুকিং বিনতান থেকে জনৈক আবু সুফিয়ান নয়া দিগন্তকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে বলেন, পুরো মালয়েশিয়ায় এই মুহূর্তে লকডাউন চলছে। তবে আগে ছিল ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার’ (এমসিও)। আর এখন সেটি উঠিয়ে ‘রিকভারি মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার’ (আরএমসিও) দিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
আলজাজিরায় রায়হান কবিরের সাক্ষাৎকার দেয়ার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন পুলিশ এখন বাঙালি দেখলেই ধরপাকড় করার চেষ্টা করছে। সামান্য ত্রুটি পেলেই দোকান বন্ধ করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বুকিং বিনতান এলাকায় বাংলাদেশী যেসব ব্যবসায়ীর দোকান রয়েছে নিয়ম অনুযায়ী সেখানে বাধ্যতামূলক হিসাবে ক্যাশিয়ার থাকতে হবে মালয় নাগরিক। কিন্তু বেশির ভাগ দোকানে ক্যাশিয়ার বাংলাদেশী থাকায় তাদের দোকান বন্ধ করে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং এসব দোকান আবার খুলছে। তবে ক্যাশিয়ার মালয় নাগরিক বসানো হয়েছে। এতে দোকানে বাড়তি খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে কাগজপত্র দেখার নামেও হয়রানি চলছে বলে বিভিন্নভাবে তারা জানতে পারছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রায়হান কবিরকে ধরতে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের ওয়েব সাইটে মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি হিসাবে ছবি ও পাসপোর্ট ঝুলছে। তার মতে, রায়হান কবিরের উচিত আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে আত্মসমর্পন করে ফেলা। নতুবা যদি সে অভিযানে ধরা পড়ে তাহলে তার উপর নির্যাতন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও রায়হান কবির আলজাজিরা টেলিভিশনে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেটি শতভাগ না হলেও অধিকাংশ সত্য ঘটনাই সে বলেছে বলে আমরা মনে করছি।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সুফিয়ান বলেন, বিশ্বে যে কয়টি দেশ করোনাভাইরাস থেকে উত্তোরণে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম সেরা। গত এক মাসে মৃত্যুর ঘটনা নেই বললেই চলে। তারা সবাকেই মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক এবং সোস্যাল ডিসট্যান্স মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে সফলতা এসেছে। মূলত মালয়েশিয়াতে লকডাউন পর্ব শেষ হয়ে গেছে ১০ জুন।
Leave a Reply