দখিনের খবর ডেস্ক ॥ বর্তমান সরকার মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার উদ্যান সংরক্ষণের জন্য ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ীই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু উল্টো সরকারের বিরুদ্ধেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধ্বংস করার অভিযোগ উঠেছে। শুধুই আইন নয়, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায় লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। পরিবেশবাদী আইনজীবীরা বলছেন, সরকার উদ্যান রক্ষায় আইন করেছে। এই আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকারের তথা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার। সেখানে সরকার ভক্ষকের ভূমিকায় নেমেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের স্থান সংরক্ষণে হাইকোর্টে একাধিক রিট আবেদন করা হয়। এসব রিট আবেদনে উদ্যান ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের পর সোহরাওয়ার্দীসংলগ্ন শিশু পার্ক ভেঙে দিয়ে সেখানে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মঞ্চ স্থাপনসহ নানা রকম কাজ চলছে। কিন্তু পাশাপাশি আইন ও রায় লঙ্ঘন করে গাছ কেটে দোকান নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে। এই গাছ কাটা ও দোকান নির্মাণ বন্ধ করতে এরই মধ্যে একাধিক পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তি সরকারকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন। ওই সব নোটিশে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, উন্মুক্ত স্থান ও উদ্যান রক্ষার জন্য সরকার ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কোনো উদ্যানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, এমন বৃক্ষরাজি নিধন করা যাবে না। কিন্তু সরকার এই আইন উপেক্ষা করে একের পর এক শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলছে। দোকান তৈরি করছে। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে এ রকম গাছ রেখেই ভূমির উন্নয়ন করার নজির রয়েছে। সে রকম কিছু করা হলেও হয়তো মেনে নেওয়া যেত। এসব না করেই সেখানে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলার কারণে বিপন্নপ্রায় অনেক পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে। এ কারণে আমরা রবিবারই হাইকোর্টে মামলা করতে যাচ্ছি।’ পরিবেশবাদী আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষায় হাইকোর্ট এক যুগ আগে রায় দিয়েছেন। ওই রায় অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা যাবে না। এমনকি উদ্যান রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০০ সালে একটি আইন করে। সেই আইন অনুযায়ীও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা যাবে না। অথচ গাছ কেটে সেখানে দোকান বানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই স্থান আগে চিহ্নিত হতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই স্থান চিহ্নিত হয়নি। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী হচ্ছে তার নকশা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু সেখানে কিসের ভিত্তিতে এসব কাজ হচ্ছে, তা কেউ জানতে পারছে না। তিনি বলেন, সরকার আইন করে নিজেই আইন মানছে না। আদালতের রায়ও মানছে না। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে। জানা যায়, উদ্যান বা উন্মুক্ত স্থান বা খেলার মাঠ কিংবা জলাধার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করে ২০০০ সালে, যা সর্বমহলে জলাধার সংরক্ষণ আইন হিসেবে পরিচিতি পায়। এই আইন করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য বিধান করা সমীচীন। এই আইনের ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এসব জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করাও যাবে না। এমনকি এসব জায়গা ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরও করা যাবে না। তিনি বলেন, এই আইন অনুযায়ী কোনো উদ্যানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, এমন কোনো বৃক্ষরাজি নিধন করা যাবে না। এটি করা হলে উদ্যানটির শ্রেণি পরিবর্তন হিসেবেই গণ্য হবে। এই আইন লঙ্ঘন করেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষায় ২০০৯ সালে সাবেক সেনাপ্রধান ও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কে এম সফিউল্লাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এই রিট আবেদনে রুল জারির পর ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ‘১) ১৯৪৮ সনের ২১শে মার্চ তারিখে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ প্রদানের স্থান; ২) ১৯৬৯ সনের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ প্রদানের স্থান; ৩) ১৯৭১ সনের ৩রা জানুয়ারি তারিখে আওয়ামী লীগ দল হইতে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যগণ কর্তৃক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান; ৪) ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ প্রদানের স্থান; ৫) ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান; ৬) ১৯৭২ সনের ১০ই জানুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ প্রদানের স্থান; ৭) ১৯৭২ সনের ১৭ই মার্চ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ প্রদানের স্থান; এবং স্মৃতিফলক/জয় স্থাপনা ও সংরক্ষণ করিতে হইবে।’ রায়ে বলা হয়, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হতে বিদ্যমান সকল স্থাপনা অপসারণ করে কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত স্থানগুলিতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনা প্রসূত দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ করবে। তবে ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বরের আগের কোন স্থাপনা এবং বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত স্মারক, ভাস্কর্য, স্মৃতিফলক বা জয়—এই আদেশের আওতাবহির্ভূত হইবে।’ রায়ে অন্য সব স্থাপনা অবিলম্বে অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়, “রমনা তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় হইতেই এ পর্যন্ত একটি বিশেষ এলাকা হিসাবে পরিগণিত হইয়াছে এবং ইহার একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐহিত্য আছে। শুধু তাহাই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। এই পরিপ্রেক্ষিতেও সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসাবে সংরক্ষণের দাবী রাখে। এখানে এমন কোন স্থাপনা থাকা উচিত নয়, যাহা এই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য বিন্দুমাত্র ম্লান করিতে পারে। কোনভাবেই ইহাকে রোগাক্রান্ত করা যায় না। যেহেতু স্মরণকাল হইতেই ইহা উদ্যান হিসাবে পরিচিত সেইহেতু ২০০০ সনের ৩৬ নং আইন অনুসারে সোহরাওয়ার্দী ‘উদ্যান’ সংজ্ঞার আওতাধীন এবং এই জায়গার শ্রেণী সাধারণভাবে অপরিবর্তনীয়। ইহাকে অনাবশ্যক স্থাপন দ্বারা ভারাক্রান্ত করা অবৈধ হইবে।” আইনের লঙ্ঘন ও হাইকোর্টের রায় উপেক্ষা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে দোকান নির্মাণ করায় একাধিক পরিবেশবাদী সংগঠন সরকারকে আইনি নোটিশ দিয়েছে। রিট আবেদনকারী মনজিল মোরসেদের পাঠানো আদালত অবমাননার নোটিশে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফরমস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), নিজেরা করি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) এবং স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন পৃথক আইনি নোটিশ দিয়েছেন।
Leave a Reply