করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, কেবলমাত্র একটি কার্যকর টিকাই পারে এ মহামারিকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে।
তাই সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা এখন কাজ করছেন যত দ্রুত সম্ভব একটি টিকা উদ্ভাবনের জন্য। কিন্তু এসব গবেষণায় বাধা হয়ে উঠছে অনলাইনে টিকা নিয়ে নানা রকমের গুজব, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, আর ভুয়া তথ্য প্রচার।
তবে সুখবর হলো, ইতোমধ্যেই অন্তত ১৩০টি করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি করেছে বিভিন্ন দেশে একাধিক কোম্পানি ।
এর মধ্যে অন্তত ৩০টি টিকা মানবদেহের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার কিছু কিছুতে আশাপ্রদ ফলও পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা যে টিকাটি তৈরি করেছেন – তা মানবদেহের ওপর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটি নিরাপদ এবং কার্যকর – অর্ধাৎ তা মানবদেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী এ্যান্টিবডি এবং টি-সেল তৈরি করে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও খুবই নগণ্য।
এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টিকা তৈরির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
এখন সবাই যে ব্যাপারটির জন্য অপেক্ষা করছেন তা হলো – বড় আকারে হাজার হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা করে এসব টিকার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া।
এর পরই শুধু সম্ভব হবে টিকার বাণিজ্যিক উৎপাদনে শুরু করা।
একটা বড় বাধা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, বড় আকারে টিকার পরীক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এর ব্যাপারে কিছু মানুষের বৈরি মনোভাব এবং নানা রকম ভুল ধারণা।
ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের যুগে এসব ভুল ধারণা বা কুসংস্কার ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে।
এদের কেউ কেউ আবার নানা রকম উদ্ভট ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাসী।
‘টিকা আপনার ডিএনএ বদলে দেবে’
ক্যারি ম্যাডেই নামে একজন অস্টিওপ্যাথ একটি ভিডিওতে এক ভুল দাবি করেছেন যে কোভিড-১৯-এর এই টিকা যাদের দেয়া হবে তাদের ডিএনএ বদলে যাবে – যেখানে মানবদেহের জেনেটিক তথ্য জমা থাকে।
তার এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে ডা. ম্যাডেই টিকা কতটা নিরাপদ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দাবি করছেন যে এতে আমরা “জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রাণীতে পরিণত হবো।
তিনি কোনো প্রমাণ ছাড়াই আরো দাবি করেন যে এই ভ্যাকসিন মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি ইন্টারফেসের সাথে যুক্ত করে দেবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, টিকার কাজ শরীরকে ভাইরাস চিনিয়ে দেয়া এবং তার সাথে লড়াই করতে দেহের রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা।
এর মধ্যে এমন কোনো উপাদান বা প্রযুক্তি থাকে না যা মানুষের ডিএনএ বদলে দিতে পারে বা তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইন্টারফেসের সাথে যুক্ত করে দিতে পারে।
ডা. ক্যারির সাথে বিবিসি যোগাযোগ করলেও তিনি তার দাবি নিয়ে এ পর্যন্ত কোন ব্যাখ্যা দেন নি।
ফেসবুকে বিতর্ক : ‘আমরা টিকা চাই না’
করোনাভাইরাস ও টিকা নিয়ে ফেসবুকে কিছু গ্রুপে প্রচুর বিতর্ক হচ্ছে। কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী দাবি করছেন তারা ভ্যাকসিন চান না, কারণ তাদের “গিনিপিগ” হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে তাদের ভয় রয়েছে।
টিকা গবেষণার গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে এসব পোস্টে বলা হয়, এত দ্রুতগতিতে করা গবেষণায় যে টিকা তৈরি হবে তা কতটা নিরাপদ হবে তা নিয়ে তাদের শংকা আছে।
কিন্তু অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান ড. এ্যান্ড্রু পোলার্ড বলছেন, নিরাপত্তার ব্যাপারে কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সব ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকার পরীক্ষা যাদের ওপর চালানো হয়েছে তাদের কারো ক্ষেত্রেই কোন বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। ১৬-১৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন তাদের টিকা নেবার পর জ্বর হয়েছে – যা প্যারাসিটামল দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা গ্রহণকারী প্রথম স্বেচ্ছাসেবক মারা গেছেন বলেও ভুয়া খবর বেরিয়েছিল – যা একেবারেই মিথ্যা। সেই স্বেচ্ছাসেবক পরে বিবিসিকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।
স্প্যানিশ ফ্লুর টিকা নিয়ে ভুয়া দাবি
সামাজিক মাধ্যমে একটি মিম বেরোয় যে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময় ৫ কোটি মানুষ টিকার কারণেই মারা গিয়েছিলেন।
কিন্তু এটা একেবারেই মিথ্যা।
প্রথম কারণ : যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, সে সময় কোনো টিকাই ছিল না।
ব্রিটেন ও আমেরিকার বিজ্ঞানীরা একটি প্রাথমিক স্তরের ব্যাকটেরিয়াল টিকা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন এটা ঠিকম কিন্তু এখন আমরা টিকা বলতে যা বুঝি সেটা তা ছিলনা। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণ যে ভাইরাস তা তখন কেউ জানতেন না।
সেসময় মৃত্যু হয়েছিল প্রধানত দুটি কারণে। একটি হলো ফ্লু সংক্রমণ, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ফুসফুসে পানি জমা।
ব্র্যাডফোর্ডের অভিজ্ঞতা
উত্তর ইংল্যান্ডের একটি শহর ব্র্যাডফোর্ডে করোনাভাইরাসের একটি টিকা পরীক্ষার আগেই নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।
শহরটির রয়াল ইনফার্মারির চিকিৎসক ডা. জন রাইট বলছেন, এতে তারা উদ্বেগ বোধ করছেন ।
ডা. রাইট সংক্রামক ব্যাধির একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কলেরা, এইচআইভি এবং ইবোলা মহামারি মোকাবিলায় কাজ করেছেন।
তিনি বলছেন, তাদের একজন কনসালট্যান্ট চিকিৎসক ফৌজিয়া হায়াতকে গালিগালাজ করে বার্তা পাঠানো হয়েছিল যে তারা নাকি জাতিগত সংখ্যালঘু রোগীদের অবহেলায় মারা যেতে দিয়েছেন।
বিল গেটস মানুষের দেহে মাইক্রোচিপ বসিয়ে দিতে চান
ডা. হায়াত তাকে বলেছেন, ব্র্যাডফোর্ডে গুজব ছড়িয়েছে যে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস কোভিড-১৯-এর টিকার মাধ্যমে রোগীদের দেহে মাইক্রোচিপ গুঁজে দিতে চান।
পাকিস্তানে নাকি এ নিয়ে খবর প্রচার হয়েছে, এবং সামাজিক মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এসব ধারণা ছড়াচ্ছে।
ডা. রাইট বলছেন, মোহাম্মদ আজীম নামে একজন কোভিড-১৯ রোগী মরণাপন্ন অবস্থায় পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত হাসপাতালে আসেননি। কারণ তার ধারণা ছিল যে জাতিগত সংখ্যালঘু রোগীরা কখনো হাসপাতাল থেকে জীবিত বেরুতে পারেন না।
সৌভাগ্যক্রমে তিনি অবশ্য ৪৮ দিন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকার পর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়তে পেরেছিলেন।
এ্যান্টিবডি টেস্টের বিরোধিতা
ডা. রাইট বলছেন, ২০০৭ থেকে ২০১০ – এই তিন বছর ধরে তারা ১২,৫০০ গর্ভবতী মহিলাকে নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিলেন – যাতে ওই নারীদের সন্তানদের স্বাস্থ্য বিষয়ে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল।
তাদের মধ্যে কয়েকজনকে এ্যান্টিবডি টেস্টে অংশ নেবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
“সবকিছুই একটা বিরাট মিথ্যে”
ডা. রাইট বলছেন, তার হাসপাতালে একজন কর্মী আছেন যিনি সেখানকার ওয়ার্ডগুলোতে কোভিড-১৮ রোগীদের দেখেছেন, কিন্তু তার পরও তিনি অনলাইনে চালু বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্বই বিশ্বাস করেন।
তিনি মূলধারার সংবাদমাধ্যমের কোনো রিপোর্ট দেখেন না।
তার কথা – “আমার ওসব দেখতে হয় না। কারণ আমি এমন লোকদের ‘ফলো’ করি যারা জানে তারা কি বলছে। আমার ভেতরে একটা অনুভূতি কাজ করছে যে পৃথিবীতে যা হচ্ছে – তা একটা বিরাট মিথ্যে। কোন্ জিনিসটা যে সত্যি আর কোনটা নয় – তা কেউ জানে না।”
“টিকার মধ্যে একটা কিছু লুকানো থাকবে”
জিসেল রেগেমা ব্র্যাডফোর্ডের সেন্ট লুক’স হাসপাতালের নার্স। তিনি পূর্ব আফ্রিকান শরণার্থীদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।
তার কথা, অনেকেরই বিশ্বাস করোনা ভ্যাকসিন হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গদের উচ্ছেদ করার একটি উপায়।
তিনি বলছেন, একটা ভিডিও ছড়িয়েছে যাতে বলা হয় যে আফ্রিকার অতি দরিদ্র মানুষদের মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা পরীক্ষা করা হবে, এবং সে ভিডিওটি লক্ষ লক্ষবার শেয়ার করা হয়েছে।
জিসেল বলেন, কিছু লোক বলছে, লোকে হাসপাতালে গিয়ে আর ফিরে আসছে না। আমি যেহেতু হাসপাতালে কাজ করি তাই আমি জানি ব্যাপারটা সত্য নয়। আমি লোকদের একথা বললে, কেউ কেউ বোঝে, কিন্তু অনেকে এখনো এটা বিশ্বাস করে না।
জিসেলের গ্রুপের একজন মহিলা হচ্ছেন কোরিন।
তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসের টিকা নিরাপদ ও কার্যকর বলে ঘোষণা করা হলেও তিনি তা নেবেন না।
“না, কখনোই না। কারণ আমি একজন কৃষ্ণাংগ এবং আমরা জানি যে একজন হলেও কালো লোককে সরিয়ে দেয়ার জন্য তৎপরতা চলছে। বছরের পর বছর ধরে চলছে। সেজন্যই আমি টিকা নেবো না কারণ ওটার ভেতর অনেক কিছু লুকানো থাকবে।”
আপনারা কি তাকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়েছেন?
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নার্সের কাজ করেন এমা ক্লিনটন।
তিনি বলছেন, “একজন এশিয়ান রোগী – যার বয়স ষাটের কোঠায় – তিনি হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। অবশেষে যখন তার পরিবার এ্যাম্বুলেন্স ডাকলো তখনই তিনি মরণাপন্ন, এবং হাসপাতালে আসার এক ঘন্টার মধ্যেই তিনি মারা গেলেন।”
“তার শোকাহত ছেলে আমাদের বলছিলেন, “উনি কিভাবে মারা গেলেন। আপনারা কি তাকে কোনো বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়েছেন? আপনারা কি তাকে হত্যা করেছেন?”
হাসপাতালের কনসাল্ট্যান্ট ডাক্তার ডেভিড গ্রিনহর্ন বলছিলেন, এধরণের প্রশ্ন করার অর্থ হলো, তার মধ্যে ডাক্তারদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার আর কোনো উপায়ই নেই।
ডাক্তার রাইট বলছেন, টিকা নিয়ে এ ধরণের গুজব এবং মিথ্যে রটনা কেন ছড়াচ্ছে তা আমাদের বুঝতে হবে এবং তা মোকাবিলা করতে হবে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply