এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই হিসাবে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। গেল অর্থবছরে (২০১৯-২০) রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকের খাতা-কলমে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) তা কমিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় আনতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে করা বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তির আওতায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ কমলেও এখনো শীর্ষে অবস্থান করছে জনতা ব্যাংক। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে এই ব্যাংকে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ২৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ঋণের হার ছিল ৪০ শতাংশ। সমাপ্ত অর্থবছরে এই স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে হার ২৪.২৫ শতাংশ। গেল বছরও খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা অর্জন করতে পারেনি ব্যাংকটি। এবারো একই লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন করোনা পরিস্থিতির কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ের টার্গেট এবারো অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর সরকারি অন্যান্য ব্যাংকের মতো জনতা ব্যাংককেও সুশাসনের বেশ ঘাটতি রয়েছে। এটি বিগত অনেক বছর ধরে চলে আসছে। এটি আরো খারাপের দিকে গেলে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বারাকত। তার সময় এই ব্যাংকটি খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। সেই বোঝা এখনো ব্যাংকটিকে বহন করতে হচ্ছে।
এ দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে চুক্তি অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জনতা ব্যাংককে ৪৯০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ (শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৪০ কোটি টাকা) আদায় করতে হবে। অন্যান্যের মধ্যে পরিচালন মুনাফা ৮০০ কোটি টাকা (এর মধ্যে নিট মুনাফা ৯০ কোটি টাকা) অর্জন, লোকসানি শাখা ৫৬টিতে নামিয়ে আনা এবং ১ হাজার ৮০টি বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ৭৫০ কোটি টাকা ও এসএমই খাতে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে হবে। জনতা ব্যাংকের নিজস্ব ভাষ্য মতে, ‘ব্যাসেল-৩’-এর মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সাথে অসম প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ব্যাংকটির প্রধান সমস্যা। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা দাঁড়াতে পারে বলে ব্যাংকটি উল্লেখ করেছে।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে দু’টি গ্রুপের কাছেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই দু’টি গ্রুপ হলোÑ ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং অ্যাননটেক্স। শেষোক্ত অ্যাননটেক্সের ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় পুরোটাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল নিজেই নিয়েছেন। অ্যাননটেক্স বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুললেও টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করেছে। গ্রাহককে তা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা তা পরিশোধ করেনি। এসব দায়ের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এই গ্রুপটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।
অন্য দিকে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিভিন্ন সরকারি তহবিল ও জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকার থেকে নগদ রফতানি-সুবিধা নিয়েছে, আবার রফতানি করেও দেশে টাকা ফেরত আনেনি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ক্রিসেন্টের পাদুকা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে ৭৫ ভাগ ছাড়ে তারা জুতা বিক্রি করছেও বলে জানা গেছে। এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রয়েছেন দুই ভাই। একজন এম এ কাদের অন্যজন এম এ আজিজ। তিনি আবার ‘জাজ মাল্টিমিডিয়ার’ প্রধানও। এদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারসহ আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
সূত্র জানায়, অধ্যাপক আবুল বারকাত চেয়ারম্যান থাকার সময় জনতা ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এমডি ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। তাদের সময়েই এসব অর্থায়ন হয়েছে।
Leave a Reply