নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ রাষ্ট্রায়াত্ত নৌপরিবহন সংস্থার সী-ট্রাক একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের উপকূলভাগে নিরাপদ নৌযোগাযোগের মাধ্যম ১৩টি সীÑট্রাকের মধ্যে ৯টিই বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৪টি সী-ট্রাক সার্ভিস চালু থাকলেও সেগুলো ইজারার মাধ্যমে চলছে। আর আগামী দু’সপ্তাহের পরই শুরু হচ্ছে নৌপথে দূর্যোগপূর্ণ মওশুম। কিন্তু সী-ট্রাকের অভাবে উপকূলবাসীর যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। যদিও সরকার ইতোপূর্বে দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশে উপকূলীয় নৌযোগাযোগকে ‘গণদায়বদ্ধ খাত’ চিহ্নিত করে ১২টি সী-ট্রাক নির্মাণে বিআইডব্লিউটিসি’কে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। তাছাড়া উপকূলীয় নৌযোগাযোগ রক্ষায় সরকারি কোষাগার থেকে সংস্থাটিকে প্রতি বছর ৫০ লাখ টাকা ভর্তুকিও প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না উপকূলবাসী। বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৫ মার্চ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের উপকূলীয় নৌপথকে ঝুকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়ে থাকে। ওই সময়ে এক ইঞ্জিন এবং সিঙ্গেল বটমের কোন নৌযানে যাত্রী পরিবহন নিষেধ। সেজন্য সরকারি অর্থে বিআইডব্লিউটিসি’র জন্য বিভিন্ন সময়ে ১২টি সী-ট্রাক সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি আরো একটি সীÑট্রাক পূনর্বাসন করা হলেও ওসব নৌযান উপকূলীয় জনগনের নিরাপদ যোগাযোগে তেমন কোন অবদান রাখতে পারছে না।
সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিসি গত প্রায় ৮ বছর ধরে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপÑহাতিয়া-ভোলা-বরিশাল উপকূলীয় নিরাপদ নৌযোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। অথচ দেশের দীর্ঘতম ওই উপকূলীয় নৌপথের জন্য সরকারী অর্থে ২টি নৌযান পূনর্বাসন ছাড়াও একটি নতুন নৌযানও সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে আরো ২টি নতুন উপকূলীয় যাত্রীবাহী নৌযান নির্মানাধীন রয়েছে। তারপরও ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামÑবরিশাল উপকূলীয় নৌযোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে কিনা তা বলতে পারছেন না কেউ। সরকারি অর্থে ১৯৯৮ সালে ৪টি, ২০০২ সালে চীনা আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ৪টি এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে আরো ৪টি উপকূলীয় নতুন সী-ট্রাক সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাছাড়াও ২০০৮ সালে বিআইডব্লিউটিসি নিজস্ব অর্থে পুরনো সীÑট্রাক ‘এসটি রূপালী’ পূনর্বাসন করে চালু করা হয়। ওসব সীÑট্রাকের সাহায্যে বরিশালÑলক্ষ্মীপুর, ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুর, ভোলাÑমনপুরা, ভোলার মির্জাকালু থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার এবং হাতিয়াÑচরবাটা ও চরচেংগা রুটে একাধিক সীÑট্রাক সার্ভিস চালু করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফূলী শিপ বিল্ডার্সে নির্মিত সীÑট্রাকগুলোতে নিম্নমানের পুরনো ইঞ্জিন সংযোজন করায় বছর কয়েকের মধ্যেই তা বিকল হতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় ইজারায়ও কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওসব সী-ট্রাক গ্রহণে রাজি হচ্ছে না। ৪টি সীÑট্রাকের মধ্যে শুধু ‘এসটি শেখ কামাল’ বর্তমানে ভোলাÑমনপুরা রুটে কোন রকমে চলাচল করছে। একই সাথে নির্মিত ‘এসটি শেখ জামাল’ ২০১৫-এর জানুয়ারি থেকে এবং ‘এসটি শেখ রাসেল’ ২০১২-এর নভেম্বর থেকে বিকলবস্থায় বিআইডব্লিউটিসির ১ নম্বর ডকইয়ার্ডে পড়ে রয়েছে। কয়েক দফায় নৌযান দুটি যেনতেন প্রকারে মেরামত করা হলেও তা কোন রুটেই চালু করা যায়নি। সম্প্রতি ওসব নৌযান দীর্ঘমেয়াদি লীজ প্রদানে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সংস্থাটির বানিজ্য পরিদফতর। কিন্তু প্রথম দফার উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পরে দ্বিতীয় দফায় পুনরায় ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ‘এসটি সুকান্ত বাবু’ নামের সীÑট্রাকটি কক্সবাজারে এক ইজারাদারের কাছে রয়েছে। তাছাড়া গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে ২০০২ সালে চীন থেকে সংগৃহীত ৪টি সী-ট্রাকের মধ্যেও ২টিই বিকলবস্থায় সংস্থার ডকইয়ার্ডে রয়েছে। তারমধ্যে ‘এসটি খিজির-৫’ গতবছর ১৭ অক্টোবর থেকে এবং ‘এসটি খিজিরÑ৭’ ২০ অক্টোবর থেকে সংস্থাটির ১ নম্বর ডকইয়ার্ডে রয়েছে। কবে ওসব নৌযানের মেরামত সম্পন্ন হবে তা নিশ্চিত নন কর্তৃপক্ষ। ‘এসটি খিজির-৬’ বিকলবস্থায় ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে চট্টগ্রামের বাংলাঘাটে পড়ে আছে। তবে ওই সিরিজের একমাত্র সচল সী-ট্রাক ‘খিজির-৮’ বরিশালÑলক্ষ্মীপুর রুটের জন্য ইজারা নিয়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রী পরিবহন করছে ইজারাদার। কোন ধরনের বাড়তি লীজমানি প্রদান না করেই সীÑট্রাকটি অন্যত্র নিয়ে যাবার বিষয়টি নিয়মবহির্ভূত হলেও সংস্থার বানিজ্য পরিদফতর তাতে সম্মতি দিয়েছে বলে জানা যায়। তাছাড়া ২০০৮ সালে নির্মিত ৪টি সী-ট্রাকের মধ্যে ‘এসটি শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত’ গতবছরের অক্টোবর থেকে সংস্থার ১ নম্বর ডকইয়ার্ডে রয়েছে। ‘এসটি ভাষা শহিদ সালাম’ গতবছরের আগষ্ট থেকে চট্টগ্রামে সংস্থার ঘাটে বসে আছে। একই অবস্থায় চট্টগ্রামে পড়ে আছে ‘এসটি ভাষা শহিদ জব্বার’ও। যদিও ‘এসটি শহিদ শেখ মণি’ হাতিয়াÑবয়ারচর রুটে চলাচল করছে, তবে ওই নৌযানটির অবস্থাও খুব ভাল নয়। তাছাড়া ‘এসটি রূপালী’ নামের সীÑট্রাকটি ২০১৪ সালের সপ্টেম্বর থেকে সংস্থার ১ নম্বর ডকইয়ার্ডে পড়ে আছে। অথচ ওই নৌযানটির সাহায্যেই সন্দ্বীপের মাঝ নদীতে অপেক্ষমান উপকূলীয় নৌযান থেকে যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার কাজটি নিরাপদে সম্পন্ন হতো। আর ২০০৮ সালে সংস্থার নিজস্ব অর্থে এসটি রূপালী খুলনা শিপইয়ার্ডে আধুনিকায়ন ও পূনর্বাসন করা হয়েছিল।
এদিকে এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মফিজুল হক জানান, কিছু সী-ট্রাক বিকল বা বন্ধ থাকতে পারে। তবে প্রয়োজনের নিরিখে সী-ট্রাকসহ অচল বা বিকল যেকোন নৌযান মেরামতের উদ্যোগে নেয়া হবে।
Leave a Reply