করোনায় ব্যাংকের লেনদেন অর্ধেকে নেমে গেছে। ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির হয়ে যাওয়ায় লেনদেনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকে নগদ জমা ও উত্তোলন কমে গেছে। একই সাথে কমে গেছে এটিএম কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন। সেই সাথে কমেছে আন্তঃব্যাংক লেনদেনও। একই সাথে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনও কমে গেছে।
আন্তঃব্যাংক লেনদেন :
সাধারণত ব্যাংকিং খাতে এক ব্যাংকের টাকার সঙ্কট হলে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নেয়। কোনো ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত তহবিল থাকলে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার দেয়া হয়। এতে সঙ্কটে পড়া ব্যাংক ধার নেয়ার জন্য বাজার চাহিদা অনুযায়ী অর্থ ব্যয় করে থাকে। এভাবে ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনকে আন্তঃব্যাংক লেনদেন বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, করোনা শুরু হওয়ার আগের দুই মাসে গড়ে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে আন্তঃব্যাংক লেনদেন হতো; কিন্তু গত এপ্রিলে তা কমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
কমে গেছে চেকের মাধ্যমে লেনদেন :
ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ বেশির ভাগ গ্রাহক লেনদেন করেন চেকের মাধ্যমে। বলা চলে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয় ব্যাংকিং খাতের মোট লেনদেনের প্রায় ৮০ শতাংশ। চেকগুলো নগদায়ন হয় ক্লিয়ারিং হাউজের মাধ্যমে। আগে কোনো গ্রাহককে চেক দিলে তা নগদায়ন হতে কমপক্ষে তিন দিন থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ দিন লেগে যেত; কিন্তু এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চেক লেনদেন হয়। ফলে এখন চেক জমা দেয়ার সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে নগদায়ন হয়ে থাকে। বর্তমানে তিনটি পদ্ধতিতে লেনদেন হয়ে থাকে। প্রথমত, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অর্থাৎ এমআইসিআর চেক, সনাতন পদ্ধতিতে এবং ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার বা ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন হয়। করোনা শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে গড়ে ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ২০৫টি চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয় ২ লাখ ৭২৪ কোটি টাকা। আর প্রায় ২৪ হাজার নন-এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে ৯৯৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় একই ধরনের লেনদেন হয়; কিন্তু মার্চ মাস থেকে এই লেনদেন কমতে শুরু করে। করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে এসে এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে লেনদেন ২ লাখ কোটি টাকা থেকে ৯৩ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেছে। মে, জুন ও গত জুলাইতে এ লেনদেন আরো কমে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ তিন মাস অর্থাৎ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে সীমিত ব্যাংক লেনদেন হয়। এর ফলে এ তিন মাসে লেনদেনের হার আরো কমে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেন হ্রাস :
গত কয়েক বছর ধরে এজেন্ট ব্যাংকিং অর্থনীতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে ব্যাংকগুলোর শাখা চালানোর ব্যয় যেমন কমছে, তেমনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোও সহজ হয়েছে। কিন্তু করোনার প্রভাবে এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গত ডিসেম্বরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা, জানুয়ারি মাসে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ২০ হাজার ২২৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেন হোঁচট খেয়ে যায়। মার্চে ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা, এপ্রিল মাসে তা ১১ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায়। মে, জুন, ও জুলাই মাসের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করা হযনি। তবে এ তিন মাসের হিসাব আরো খারাপ অবস্থানে নেমে গেছে এজেন্ট ব্যাংকিং লেনদেন।
কমে গেছে এটিএম কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন :
আগে ব্যাংকের শাখাগুলোয় গিয়ে টাকা জমা ও উত্তোলন দিতে হতো। কিন্তু ব্যাংকিং সেবা আধুনিকায়ন করায় এখন ছোট ছোট লেনদেনগুলো গ্রাহককে আর ব্যাংকের শাখায় যেতে হয় না। বিভিন্ন ধরনের এটিএম কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন ও জমা দেয়া হয়। একই সাথে বিভিন্ন বিপণিবিতানে কেনাকাটাও করা হয় বিভিন্ন প্রকার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। করোনার প্রভাবে এ ইলেকট্রনিক লেনদেনেও ধস নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে এটিএম কার্ডে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৭৯টি লেনদেন সংগঠিত হয়। এতে ১৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়। জানুয়ারি মাসে লেনদেন হয় ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারি মাসে লেনদেন হয় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এপ্রিলে এসে লেনদেন ৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের আয় কমে যাওয়ায় ও বিভিন্ন অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটিএম কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে ধস নেমে গেছে। তেমনিভাবে গত ডিসেম্বরে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে যেখানে ১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়, সেখানে এপ্রিলে এসে ৪৫৪ কোটি টাকায় নেমে গেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনেও ধস :
করোনার প্রভাবে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনেও ধস নেমে গেছে। করোনাভাইস প্রাদুর্ভাবের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বেশির ভাগ শহরে লকডাউন থাকে। এপ্রিল মাস থেকে এ লকডাউনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। এতে আয় কমে যাওয়ায় গ্রামে থাকা পরিবার-পরিজনের কাছে অর্থ পাঠাতে পারেননি। আর এ শ্রেণীর মানুষের অর্থ পাঠানোর প্রধান মাধ্যম ছিল মোবাইল ব্যাংকিং। তাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনও কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ডিসেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয় ৪০ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এটা গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন ছিল। কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনও কমে যায়। গত এপ্রিলে এসে এ লেনদেন ২৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। আর মে, জুন ও জুলাই মাসে এসে তা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক লেনদেনও কমে গেছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলো পরিচালন ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক লোকবল ছাঁটাই করছে। কোনোটি বেতনভাতা কমিয়ে দিচ্ছে। এভাবে ব্যয় কমিয়ে ব্যাংকগুলো টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এটি যত দীর্ঘায়িত হবে ততই দেশের অর্থনীতির জন্যও অসনিসঙ্কেত দেখা দেবে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।
Leave a Reply