অবশেষে মুখ খুললেন লিওনেল মেসি। আর সেটা কোর্টের বারান্দায় যাওয়ার আগেই। বার্সেলোনার অলটাইম লিডিং স্কোরার লিওনেল মেসি শুক্রবার জানিয়েছেন, বার্সেলোনায় ২০২০-২০২১ মৌসুমে খেলবেন। কোনো ক্লাবের পক্ষে এত রিলিজ ক্লজ (৭০০ মিলিয়ন ইউরো) দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আর বার্সেলোনাকে তিনি ভালোবাসেন বিধায় কোর্টে গিয়ে রফা করতে চাননি। অবশ্য চিত্র এমন ছিল না শুক্রবার মেসির এই কথাগুলোর কয়েক ঘণ্টা আগে। মেসির বাবা এজেন্ট হোর্হে মেসি স্পেনের লা লিগা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন রিলিজ ক্লজ ফ্রি করে দেওয়া হয়। মেসির বাবার সঙ্গে আইনজীবী ছিলেন। কোর্টে ব্যাপারটি যাচ্ছে এমন অনুমান ছিল। তবে মেসি সেটি চাননি বিধায় আরও এক মৌসুম তিনি বার্সেলোনায় থেকে যাচ্ছেন। ফুটবলের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট গোল ডটকমের রুবেন উরিয়া মেসির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। পুরো সাক্ষাৎকারটি দৈনিক আমাদের সময়ের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
গোল : আপনি এতটা দেরি করে নীরবতা ভাঙলেন কেন এবং সব কিছু বলছেন?
মেসি : প্রথমত লিসবনে (চ্যাম্পিয়নস লিগ, বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে) ওই হারের পর অনেক কঠিন ছিল পরিস্থিতি। আমরা জেনেই খেলতে গিয়েছিলাম যে বার্য়ান অনেক কঠিন প্রতিপক্ষ। কিন্তু ওভাবে শেষ হবে (৮-২ ব্যবধানে হার) চাইনি। এমন হারে বার্সেলোনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চাইনি। এটা ভুল ধারণা। আমার মনে হয়নি যে কিছু করার আছে। আমি শুধু চেয়েছি সময় ক্ষেপণ করতে। আর খারাপ সময়টা পার হয়ে যাওয়ার পর সব কিছু ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি।
গোল : বার্সেলোনাকে আপনি কেন বললেন যে চলে যাবেন?
মেসি : আমি ক্লাব ও প্রেসিডেন্টকে বলেছি চলে যেতে চাই। পুরো বছরই বলে আসছি। আমার মনে হয়েছিল সরে যাওয়ার সঠিক সময় এখনই। আমি বিশ্বাস করি এ ক্লাবটির আরও তরুণ খেলোয়াড় দরকার। নতুন খেলোয়াড়দের নতুন ভাবনা থাকে। তাই আমার মনে হয়েছে আমারই বার্সেলোনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। খুব কষ্ট হয়েছে ভাবতে আর দুঃখ পেয়েছি। সব সময় চেয়েছি বার্সেলোনায় আমার ক্যারিয়ার শেষ করব। খুব কঠিন একটি বছর পার করেছি। ট্রেনিং, ড্রেসিং রুম ও খেলায় ভুগেছি আমরা। সব কিছুই আমার জন্য কঠিন ছিল। আর সে জন্য সেই সময়টি চলে আসে বিবেচনার জন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের। বায়ার্নের বিপক্ষে যে ফল হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগে সেটার জন্য নয়। আমি সরে যাব এই চিন্তাভাবনা দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ে চলেছিলাম। আমি প্রেসিডেন্টকে বলেছি। প্রেসিডেন্ট সব সময় বলতেন, মৌসুম শেষ হলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আমি থাকতে বা চলে যেতে চাইলে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু তিনি সে কথা রাখেননি।
গোল : আপনি কখনো নিজেকে একা ভেবেছেন?
মেসি : না। আমি কখনো নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবিনি। অনেকেই আছেন যারা আমার পাশে ছিল। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল আর শক্তি জোগাত। এটি ঠিক আমি কষ্ট পেয়েছি। অনেক কাছের মানুষ ও সাংবাদিক নানা কথা বলেছেন। বার্সেলোনার প্রতি আমার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমার আসলে এটি প্রাপ্য ছিল না। মানুষ যখন সত্যি বলে সেটি আমার জন্য ভালো। বিশ্ব ফুটবল খুব কঠিন জায়গা। এখানে অনেক ভুয়া মানুষ রয়েছেন। এ ঘটনায় আমার অনেক মানুষ চেনা হয়েছে। অনেক আঘাত পেয়েছি যখন বার্সেলোনার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমি থাকি আর না থাকি বার্সেলোনার প্রতি আমার ভালোবাসা বদলাবে না কোনোদিন।
গোল : অনেকে প্রশ্ন তুলেছে যে টাকার জন্য আপনি চলে যাচ্ছেন। ২০ বছর বার্সেলোনার জার্সি পরার পর এটা আপনাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে?
মেসি : টাকার কথা বা বন্ধুদের সব ব্যাপার, যে কোনো কিছুই আমাকে আঘাত করেছে। আমি সব কিছুর পর ক্লাবকে প্রাধান্য দিয়েছি। বার্সেলোনা ছাড়ার অনেক সুযোগ আমার ছিল। টাকার জন্য? প্রতিবছর আমি ক্লাব ছাড়তে পারি। আর বার্সেলোনা থেকেও বেশি অর্থ আমি পাব। আমি সব সময় বলেছি এটিই (বার্সেলোনা) আমার ঘর। এটি আমার অনুভূতিতে রয়েছে। তবে এখানকার চেয়ে কোথাও ভালো হবে ভাবা সেটা কঠিন আমার জন্য। আমার কাছে মনে হয়েছে একটা পরিবর্তন দরকার, নতুন লক্ষ্য ও নতুন কিছুতে মগ্ন হতে চেয়েছি।
গোল : সব কিছুর পর ২০ বছর অনেক লম্বা সময়। আপনার পরিবার, এই বার্সেলোনা শহর , বন্ধু , পরিবেশ ফেলে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। আপনি এখনো বার্সেলোনায় থাকছেন।
মেসি : অবশ্যই। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। আর আবারও বলছি বায়ার্ন মিউনিখের ফলের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেইনি। আরও অনেক কারণে আমার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সব সময় বলেছি যেহেতু এখানেই শেষ করব। তাই আমার মনে জয় ভিন্ন কিছু ছিল না। বার্সেলোনার মতো ক্লাবে থেকে আধিপত্য করা ও ট্রফি জেতা অন্য রকম ভালোলাগা আমার। সত্যি কথা বলতে এখানে আর কোনো কিছু দীর্ঘ মেয়াদে থাকছে না। নিম্নমুখী মনে হচ্ছে সব কিছু। আগেও বলেছি আমি সব সময় ক্লাবের কল্যাণ, আমার পরিবার ও বার্সেলোনাকে নিয়েই ভেবেছি।
গোল : আপনি যখন পরিবারকে জানালেন বার্সেলোনা ছাড়ছেন তখন কী ঘটেছিল?
মেসি : আমি যখন স্ত্রী ও বাচ্চাদের বললাম যে বার্সেলোনা ছেড়ে দেব তখন নাটকীয়তা শুরু হয়। পুরো পরিবার কান্না করছিল। তারা এটি মেনে নিতে পারছিল না। আমার বাচ্চারা বার্সেলোনা ছাড়তে চাইছিল না। আর তাদের স্কুল এখানে। সেটা পরিবর্তন করতেও চায়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঠের মানুষ। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফুটবল খেলি লড়াই করতে ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে চাই। আপনি জিতবেন ও হারবেন সেটা এক ব্যাপার। এটা কঠিন। কিন্তু আপনাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। আর সেটা করতে পারলে চ্যাম্পিয়নস লিগে রোমা, লিভারপুল ও লিসবনের ঘটনা ঘটত না। আমার এই ঘটনাগুলো মাথায় আঘাত করেছে। আমি এসবের দায়ভার নিয়ে সরে যেতে চেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে আমি যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারব। আমার প্রেসিডেন্ট সব সময় সেটা আমাকে বলেছে। আমি থাকব কি থাকব না সেটার সিদ্ধান্ত আমার। এখন তারা বলছে ১০ জুনের আগে কেন বললাম না। করোনা পরিস্থিতি সবাই দেখেছে। আর লা লিগা মৌসুমও পিছিয়েছে। তা হলে আমার ওই চুক্তির মেয়াদ কেন গত মৌসুমের শেষ পর্যন্ত আসবে না। ফলে আমাকে এখন বার্সেলোনায় থাকতেই হচ্ছে। কারণ আমাকে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এটাই একমাত্র পথ যে আমাকে বার্সেলোনায় থাকতে হবে। আর না হলে ৭০০ মিলিয়ন ইউরো ক্লজ দিয়ে যেতে হবে। যেটা একেবারে অসম্ভব। আর একটা পথ খোলা থাকে। আর সেটা হচ্ছে কোর্টের ট্রায়ালে যাওয়া। আমি কখনই কোর্টে বার্সেলোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব না। এই ক্লাব আমার ভালোবাসা। এই ক্লাব আমাকে সব দিয়েছে যখন থেকে আমি এসেছি। এই ক্লাব আমার জীবন। আমার জীবন গড়ে দিয়েছে এই বার্সেলোনা। ফলে বার্সেলোনার বিরুদ্ধে আমি কোর্টে লড়তে চাইনি।
গোল : আপনি নিজে অনেক আঘাত পেয়েছেন। অনেকে দাবি করছে আপনিও ব্যথা দিয়েছেন। অনেকে আপনার ক্লাবের প্রতি কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করেছে। এ ব্যাপারটি নিয়ে কিছু বলুন।
মেসি : ক্লাবের প্রতি আমার আনুগত্য বা কমিটমেন্ট যেটা বলছেন এটা নিয়ে প্রশ্ন হওয়ায় কষ্ট পেয়েছি। এ সব ছাপা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। অনেকে ভেবেছে আমি কোর্টে যাব নিজের লাভ ও স্বার্থের জন্য। আমি যেটা কখনো করতে পারব না। আবারও বলছি, আমি এখান থেকে যাওয়ার অধিকার রাখি। এটা আমার অধিকার। কারণ এ চুক্তি বলছে , আমাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। আমি চলে যাব। শেষ কথা বলে দিতে পারি। আমি চলে গেলে আমারও অনেক ক্ষতি হবে। আমার কাছে সুখী থাকাটাই মূল। আমি বার্সেলোনার শেষ দিনগুলোয় হাসি-খুশি থাকতে চেয়েছি।
গোল : বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট বার্তেমিউকে নিয়ে কিছু বলেন।
মেসি : আমি মোটেও সুখী ছিলাম না। আমি চলে যেতে চেয়েছি। কোনো ধরনের আইনি লড়াই চাইনি। এ ক্লাবের যে ম্যানেজমেন্ট যেটির প্রধান বার্তেমিউ সেখানে ধ্বংস চলছেই।
গোল : আসল ব্যাপার সুখী থাকা। আপনি জয়ের জন্য জন্মেছেন। আপনার জন্য বার্সেলোনা ইউরোপে দাপট করে। কিন্তু বার্সেলোনায় পরিবর্তন দরকার তাই না? আবার খেলার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দরকার আছে কিনা?
মেসি : আমি বার্সেলোনার হয়ে এখন খেলব। আমি যাব কি যাব না সেটা নিয়ে ভাবছি না। আমি সেরাটা দিতে চাইব। সব সময় জিততে চাই। কখনো হারতে পছন্দ করি না। ক্লাবের জন্য সর্বোচ্চটা দেব। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে কী হবে বলতে পারব না। নতুন কোচ (রোনাল্ড কোম্যান) এসেছেন। তার নতুন নতুন আইডিয়া রয়েছে। এটি ভালো। তবে ভাবতে হবে দলের চাহিদা কী। কোথায় কী প্রয়োজন হবে। তা না হলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াই করা কঠিন হবে। আমি আছি আর বার্সেলোনার হয়ে সর্বোচ্চটা দেব।
গোল : অনেকে বলেছে আপনার অনুভূতি নেই। আপনি বার্সেলোনা ছেড়ে যাবেন এটি নিয়ে কোনো আবেগ দেখাননি।
মেসি : আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। যখন শুনেছি বার্সেলোনার প্রতি আমার কমিটমেন্টের অভাব। আমি এ ক্লাবের প্রতি পুরো অনুগত। বার্সেলোনাকে আমি ভালোবাসি বলেই অন্য কোথাও ভালো অফার এলেও আমি চলে যাইনি। এখনো আমার অন্য কোথাও চলে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমি নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পারি। আমার ছেলে, পরিবার এখানে বড় হয়েছে। এখন চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সেখানে ভুল কী আছে জানি না।
গোল : পরিবার আপনার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সে ব্যাপারে কিছু বলেন।
মেসি : পরিবার আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমার বাবা ছাড়া স্ত্রী আমার ব্যথা বুঝতে পারেন। সব সময় তারা আমার পাশে ছিল। মাতেও অনেক ছোট। সে এখনো বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। কোথাও চলে গেলে কী হবে। তবে বড় ছেলে থিয়াগো স্কুল ছাড়তে চায়নি। সে টেলিভিশনে খবর দেখে বুঝতে পেরে আমাকে প্রশ্ন করেছিল। আমি তাকে জানাতে চাইনি। আমি তাকে বলেছিলাম নতুন জায়গায় নতুন বন্ধু হবে। সে আমার কথা মানতে চায়নি। সে থেকে যাওয়ার জন্য কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছে।
গোল : অবশ্যই ২০ বছর এক জায়গায় আছেন। কঠিন পরিস্থিতি। আপনি যখন ছোট ছিলেন তখন এসেছেন বার্সেলোনায়। আপনি আর যা-ই হোক বার্সেলোনায় থাকছেন। বার্সেলোনার সমর্থক ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
মেসি : সোজা কথা। আমি আমার সেরাটা দেব। আশা করি প্রতিটি পরিস্থিতিতে আমি সেরাটা দেব। আমি মানুষের জন্য ফুটবল খেলি। সবার খারাপ সময় যাচ্ছে। এ বছরটি ভালো যাচ্ছে না কারও। করোনা ভাইরাসে সবার জীবন বিপর্যস্ত। অনেকে স্বজন হারিয়েছেন। আমি জয়ের জন্য সব কিছু করব। সবাই খারাপ সময় অতিবাহিত করতে পারবেন আশা করি। আশা করি সবাই করোনা মহামারীর পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
গোল : আপনি ব্যুরো ফ্যাক্স কেন দিয়েছেন সেটি নিয়ে কথা উঠেছে। আপনি এ ব্যাপারে অবস্থানটি বলতে পারেন।
মেসি : ব্যুরো ফ্যাক্স এক প্রকার অফিশিয়াল বার্তাই কোনো না কোনোভাবে। আমি পুরো বছর প্রেসিডেন্টকে বলেছি। আমি চলে যেতে চেয়েছি। আমার মনে হয়েছে এটিই সময় নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার। আমার ক্যারিয়ারের তো একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। তিনি সব সময় বলতেন আমরা কথা বলব। কিন্তু তিনি (বার্তেমিউ) কথা বলতেন না। প্রেসিডেন্ট আমাকে কোনো ক্লুই দিতেন না। আমি চেয়েছি ব্যুরো ফ্যাক্সের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে। ওই সময় আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে চলে যাব।
Leave a Reply