পেঁয়াজের দামে লাগাম টানতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অভিযানের ফল হলো উল্টো। আগের দিন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানার প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে আড়তদাররা গতকাল সোমবার দিনভর দোকান বন্ধ রাখেন। রাস্তায় নেমে করেছেন মিছিল-সমাবেশ। এটিকে অভিযান বন্ধ করার চাপ এবং দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই দেখছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আর বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আড়ত বন্ধ থাকার খবর প্রচার হলে বাজার দ্রুত অস্থিতিশীল হবে। সংকট দেখা দেবে পেঁয়াজের সরবরাহের ক্ষেত্রে। তখন দাম বাড়ানো যাবে ইচ্ছে মতোই।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে অন্তত ৫০ আড়তদার জড়ো হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিরুদ্ধে মিছিল করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেন কর্মচারীরাও। মিছিল-সমাবেশের মুখে অন্য আড়তদাররাও তাদের দোকান বন্ধ রাখেন। আড়তদাররা পেঁয়াজের বস্তা ফেলে খাতুনগঞ্জের সড়ক অবরোধ করেন। ফলে গতকাল দেশের প্রধান পাইকারি বাজারটির ওই অংশে কোনো ধরনের যানবাহনও চলাচল করতে পারেনি।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে কয়েক ঘণ্টার কর্মসূচি চললেও সেখানে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার লোকজন গিয়ে তাদের বাধা দেয়নি। দুপুরে মিছিল-সমাবেশ শেষ হলেও আর দোকান খুলেননি আড়তদাররা। ফলে খুচরা ক্রেতারা খাতুনগঞ্জে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন। গতকাল সোমবারও খাতুনগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা ছিল। তা শোনেই উল্টো আড়তদাররা দোকান বন্ধ রেখে সমাবেশ শুরু করেন।
তবে বিকালে ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে এ আন্দোলনের সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট নন বলে দাবি করেছেন। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ও সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, আড়তদারদের এ কর্মসূচি সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের প্রতিবাদে ৫০ জনের মতো আড়তদার এ কর্মসূচি পালন করেছেন। পূর্বঘোষণা ছাড়া আন্দোলন সংগঠন সমর্থন করে না।
আড়তদারদের ভাষ্য, পেঁয়াজের দাম বাড়ান আমদানিকারকরা। তাদের কোনো জরিমানা করা হয় না। অথচ মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয় আড়তদারদের, যেটি অযৌক্তিক। অভিযান বন্ধের আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আড়ত বন্ধ রাখা হবে।
ঊর্ধ্বমুখী পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে গত রবিবার বিকালে নগরীর পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে অভিযান চালান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক ও শিরিন আক্তার। ওই অভিযানে ১০ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করেন তারা। এর পরই প্রতিবাদে গতকাল সোমবার সকাল থেকে খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আড়ত বন্ধ রাখেন।
আড়তদারদের আন্দোলতে ব্যাপক চটেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, তারা প্রথমত বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ব্যবসা করছেন। আবার নিজেদের স্বার্থে আড়ত বন্ধ রেখে বিক্ষোভ মিছিল করছেন। সব তো তারাই করছেন। জরিমানা করাটা অযৌক্তিক মনে করলে ব্যবসায়ীরা আমার কাছে আসতে পারেন। তা না করে তারা জনগণকে ভোগান্তি দিয়ে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগামীকালও (মঙ্গলবার) যদি তারা আমার কাছে না আসে তা হলে পূর্বঘোষণা ছাড়া যারা আড়ত বন্ধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে- এমন খবরে দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে কয়েক দিন ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। পেঁয়াজের দামের লাগাম টানতে খাতুনগঞ্জে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন।
গত রবিবার জরিমানা করা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, নিয়ম না মেনে এবং ক্রয় রশিদ না রেখে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রেতাদের জরিমানা করা হয়েছে। এখন তারা আমদানিকারকদের অজুহাত দিয়ে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়াতে আড়ত বন্ধ করেছেন। মূলত আজও (সোমবার) অভিযান হওয়ার কথা থাকায় অভিযান ঠেকাতে পেঁয়াজের আড়ত বন্ধ করে সকাল থেকে বিক্ষোভ করছেন। অভিযান ঠেকাতে ব্যবসায়ীদের এ আন্দোলন।
পেঁয়াজের আড়তদার আবদুল জব্বার বলেন, আমাদের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। যা বাড়ান আমদানিকারকরা। অথচ প্রতিবার দেখা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটরা আমাদের জরিমানা করেন। কোনো আমদানিকারককে জরিমানা করতে এখনো দেখিনি। তাদের বিষয়ে তদন্ত করা হোক। তা হলে দাম বাড়ানোর আসল কারিগর কারা সেটি বেরিয়ে আসবে।
খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, সংগঠন থেকে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। মূলত জরিমানার শিকার ব্যবসায়ীরা আড়ত বন্ধ রাখার পর সব আড়তই বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, পণ্যের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে আড়তদারদের ভূমিকা নেই।
ক্যাবের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি এসএম নাজের হোছাইন আমাদের সময়কে বলেন, আমদানিকারকরা কি পরিমাণ পেঁয়াজ কত টাকা দামে আমদানি করেন সেটির হিসাব সরকারের কাছে থাকে। কিন্তু আড়তদাররা তাদের পণ্য ক্রয়ের রশিদ দেখালে বিষয়টি সুরাহা হয়। অভিযানের সময় ক্রয় রশিদ ঠিকঠাক না পেলে তো ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করবেনই? আর আমদানিকারকদের দাম বাড়ানোর অজুহাত দিয়ে যারা পেঁয়াজ কিংবা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ান তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জরিমানা করার কারণে যদি আড়তদাররা ভোক্তাদের ভোগান্তিতে ফেলেন তা হলে সেটিকে কঠোর হাতে দমন করা উচিত। তিনি বলেন, আড়ত বন্ধ রাখা মানে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়া। আড়ত থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ হলে খুচরা পর্যায়ে দাম আপনাআপনি বেড়ে যাবে। তখন দামের লাগাম টানা কষ্টকর হবে।
পেঁয়াজের খুচরা বাজারেও জরিমানা : পেঁয়াজের দাম ঠিক রাখতে খুচরা বাজারেও অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। অভিযানে ৯ ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করা হয়। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরীর খুচরা বাজার আগ্রাবাদের চৌমুহনী বাজার ও দুই নম্বর গেটের কর্ণফুলী মার্কেটে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরিন আক্তার ও উমর ফারুকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এর আগে তারা রবিবার খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের পাইকারি বাজারে ১০ ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছিলেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, অভিযানে অতিরিক্ত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি ও মূল্য তালিকা না থাকায় কর্ণফুলী মার্কেটের হাজা স্টোর, নিউ বিসমিল্লাহ স্টোর, কাশেম স্টোরকে দুই হাজার টাকা, হাজী স্টোরকে এক হাজার টাকা ও চোমুহনী মার্কেটের নুরে মদীনা স্টোর, সাগর স্টোরকে দুই হাজার টাকা, এক হাজার টাকা করে মিলন স্টোর, আরিফুল স্টোর, আলাউদ্দিন স্টোরকে জরিমানা করা হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, সরেজমিন খুচরা বাজারে দেখা যায়, কম দামে পেঁয়াজ কেনা থাকলেও বাজারে পেঁয়াজের দাম বেশি বলে তারা কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধিতে বিক্রি করছেন। ফলে তাদের অর্থদ- করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট দেখে অনেক দোকানি সাঁটানো মূল্যতালিকায় দাম কমিয়ে ঘষামাজা করে লিখতে দেখা যায়। এমনকি অনেক দোকানে মূল্যতালিকা নেই। ফলে তারা নিজেদের মতো করে দাম নিতে দেখা যায়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরিন আক্তার বলেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে পেঁয়াজের মূল্য যাতে বৃদ্ধি না পায় সে ক্ষেত্রে আমাদের বাজার তদারকি অব্যাহত আছে। যদি পেঁয়াজের দাম আগের মতো কারসাজি করে মূল্য বৃদ্ধির পাঁয়তারা করে তা হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধিতে কারা জড়িত তার খোঁজখবর নিয়ে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
Leave a Reply