নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নে অবস্থিত সুলতানী আমলের নিদর্শন গজনী দীঘি। প্রতি বছর গজনী মেলা মিলতো এখানে। বাতাস ফকিরের আস্তানায় হাজার হাজার মানুষ আসতো কল্যাণের আশায়। কেউবা দীঘিতে গোসল দিতেন, কেউবা মাছকে দিতেন খাবার। ঐতিহ্যের সেই নিদর্শন এখন বেহাত হওয়ার পথে। দীঘির পাড় দখলে দীর্ঘদিন একটি মহল ছিল মরিয়া। এবার তারা এটি লিজ নিয়ে সম্পূর্ণ দখলের পায়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বরিশাল পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়ন পরিষদের আহবায়ক ও জেলা পরিষদ সদস্য মুনাওয়ারুল ইসলাম অলি বলেন, গজনী দীঘি বরিশালের তথা দেশের একটি ঐতিহ্য। আমরা দীর্ঘদিন যাবত এটি পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় নিয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কার ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবী জানি আসছি। যে কোন মূল্যে এটি বেহাত হওয়ার হাত থেকে রক্ষ করতে হবে। আমরা পূর্বাঞ্চলবাসী এটি রক্ষা প্রয়োজনে যে কোন কর্মসূচী গ্রহণ করবো। চাঁদপূরা ইউনিয়ন আ’লীগ সভাপতি ফারুক আলম খান লিটন বলেন, গোপনে গজনী দীঘি লিজ দেওয়ার পায়তারা চলছে। দেশের এমন একটি ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক নয়। বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) মেহেদী হাসান বলেন, আমরা এটিকে বেদখলমুক্ত করছি। পরে লিজ দেওয়া যায় কিনা সেটা দেখা হবে। তবে এখনই আমরা এটি লিজ দিচ্ছিনা। জানা গেছে, সুলতানী আমলে গজনীর কোনো এক সুলতান বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনে এই দীঘী খনন করেন এবং স্থানীয় জাগীরদার বা জমিদারকে এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন।
যে কারণে এ দিঘীটির নাম গজনীর দিঘী ছিল। আহঞ্জী বা ইসলাম ধর্মের প্রচারকারী হবার সুবাদে বরিশালের চাঁনপুরা ইউনিয়নের মানুষের কাছে আহঞ্জীদের আদিপিতা ইয়ারউদ্দিন আখনের গ্রহনযোগ্যতা ছিল অনেকটাই জমিদারদের মত দেখতে। বিচার আচার, সামাজিক যেকোন সমস্যার সমাধানে এ অঞ্চলের মানুষেরা এখনো আহঞ্জী (বর্তমান তালুকদার) বাড়ি নির্ভর। যে কারণে গজনীর দীঘীটাও আহঞ্জীদের নিয়ন্ত্রণে দেন তদানিন্ত গজনীর সুলতান। মুখে মুখে শোনা যায়, পরবর্তীতে এই গজনীর দিঘীর বিশুদ্ধ পানির সুবিধা গ্রহণ করতে এখানে বাতাস ফকির নামের একজন দরবেশ আশ্রয় গ্রহণ করেন। আহঞ্জীরা ঐ দরবেশের থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা করে দিলে তাকে ঘীরে এখানে আশে পাশে বসত শুরু হয়। জমে ওঠে ধর্মীয় নানান উৎসব ও মেলা। গজনীর মেলায় নিয়মিত ঘোড়ার দৌড়ের আয়োজন হত বলে এ মেলা অনেকদূর পর্যন্ত সুখ্যাতি লাভ করত। পুকুরের উত্তর পারে একটি গাছ ছিল, যেটির কষ ছিল রক্ত লাল। গাছটিতে কোপ দিলেই রক্ত বের হতো আর তা দেখতে ভিড় করত দূর দূরান্তের মানুষ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তখনকার আমলে ঐ গাছটিকে পূজা শুরু করলে বাতাস ফকির এটি কেটে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিলেন। এটা দেশভাগের অনেক পূর্বের কথা। বাতাস ফকিরের পরামর্শে আহঞ্জীরা গজনী কে দান করে দেন জনগণের কল্যানে। যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চাপে ইউনিয়ন পরিষদের উপর। স্বাধীনতার পরেও গজনীর মেলা বা থৈল ছিল ঐ অঞ্চলের সেরা বিনোদন। সেখানে নিয়মিত ঘৌড় দৌড় হতো। পরবর্তীতে নাসির নামে এক যুবক হত্যার ঘটনায় ঐ মেলা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গজনী চলে যায় উপজেলা পরিষদের অধীনে । খুবই চমৎকার আর বিশাল এই পুকুরটি পিকনিক স্পট করার কথা উঠেছিল ১৯৮৫ সালে । ১৯৮৯ থেকে ৯২ সময়ে স্থানীয় কতিপয় যুবক মনির দর্জি সহ ফ্রেন্ডস সোসাইটি এবং ২০১৪-১৬সাল বরিশাল পূর্বাঞ্চল ছাত্রপরিষদ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে গজনীকে বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে । চমৎকার ও বিশাল নলি পানির পুকুরটির সাথে রামসাগর ও দূর্গা সাগরের তুলনা চলে। অথচ আজ একী দেখছি? পুকুরের দক্ষিণ পাড় পুরোটাই দখল করে গড়ে উঠেছে বসতভিটা। পূর্বপাড়ও অনেকটা বেদখল। আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে এই গজনীর দীঘী ছিল আহঞ্জীদের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। এরপর কিভাবে এটি জল সরকারের আর পাড় ব্যাক্তিগত হলো? আহঞ্জী বাড়ীর লোকরা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা কীভাবে এই পাড় বিক্রী করছে তা বোধগম্য নয়।’
Leave a Reply