উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন আজ। এ বছর তিনি পা রাখলেন ৯১ বছরে। ১৯২৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন লতা। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এক হাজারের বেশি ভারতীয় ছবির জন্য গান গেয়েছেন ভারতের বুলবুল খ্যাত এই শিল্পী। বাংলায়ও করেছেন অনেক গান। শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়, এখন পর্যন্ত ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। ধ্রুপদী থেকে রোমান্টিক, গজল, ভজন-গানের প্রতিটি ধারায় তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ-সুরেলা আবেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে সংগীত পিপাসুদের। পাঠক, আজ আমরা আপনাদের জানাব লতার জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনার কথা
হ মাত্র তেরো বছর বয়সে তার কাধে ওঠে সংসারের ভার। অভিনয় আর গান দুটোই করতে হতো সমানতালে। না হলে ছোট ছোট ভাইবোনকে নিয়ে মা যে অকূল পাথারে পড়বেন! সে দিনের বালিকা আজ নবতিপর। মধুকণ্ঠে তিনি চির কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর।
হ তার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব এবং ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী। বংশসূত্রে ছিলেন গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের পূজারী ব্রাহ্মণ। সেই গ্রামের প্রখ্যাত শৈব পীঠস্থানও পরিচিত ‘মঙ্গেশি‘ মন্দির নামে। সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তথা অভিষেককারী ছিলেন দীননাথের বাবা, গণেশ হার্দিকর।
হ দীননাথের মা, তথা লতার ঠাকুমা যেশুবাঈ ছিলেন গোয়ার দেবদাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। পরে সেই সম্প্রদায়ের নাম হয় গোমন্তক মারাঠি সমাজ। হার্দিকর থেকে নিজের পদবী ‘মঙ্গেশকর’ করে নেন দীননাথ।
হ সম্পন্ন গুজরাতি ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে নর্মদাকে ১৯২২ সালে বিয়ে করেন দীননাথ। তাদের সন্তান লতিকা মারা যায় শৈশবে। এই শোক সহ্য করতে পারেননি নর্মদা। কয়েক দিনের মধ্যে তিনিও প্রয়াত হন।
হ এরপর নর্মদার বোন সেবন্তীতে বিয়ে করেন দীননাথ। কিন্তু এই বিয়েতে আপত্তি ছিল সেবন্তীর পরিবারের। ইনদওরে ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় তাদের প্রথম কন্যাসন্তানের। নাম রাখা হয় হেমা। পরে মঙ্গেশকর দম্পতি ঠিক করেন, মেয়ের নাম হবে লতিকা থেকে লতা।
হ দীননাথের নাটক ‘ভাও বন্ধন’-এর একটি চরিত্রের নামও ছিল লতিকা। শৈশবে বাবার কাছেই গানের হাতেখড়ি লতার। দীননাথের জহুরি-চোখ ভুল করেনি প্রতিভা চিনতে। কিন্তু তিনি মেয়ের সাফল্যের কিছুই দেখে যেতে পারেননি।
হ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে লতা প্রথম অভিনয় করেন বাবার নাটকে। তার যখন তেরো বছর বয়স, মারা যান দীননাথ। আশা, ঊষা এবং ভাই হৃদয়নাথ তখন শিশু। পারিবারিক বন্ধু মাস্টার বিনায়কের সংস্থায় মারাঠি ছবিতে অভিনয় শুরু করেন শিশুশিল্পী লতা ও আশা। ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি ‘কিটি হাসাল’-এ প্রথম প্লেব্যাক। কিন্তু সে গান পরে বাদ পড়েছিল।
হ ১৯৪৫ সালে মাস্টার বিনায়কের সংস্থা চলে এল বম্বে (বর্তমান মুম্বাই)। লতাও চলে এলেন সেই শহরে। এ বার শুরু হল ধ্রুপদী সংগীতের তালিম। পাশাপাশি অন্নসংস্থানের জন্য চলতে লাগল মারাঠি ও হিন্দিতে নানা ধরনের প্লেব্যাক।
হ তিন বছর পর মারা যান মাস্টার বিনায়ক। ওই সময় লতার পাশে দাঁড়ান গুলাম হায়দর। তিনি তাকে নিয়ে যান শশধর মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
হ প্রযোজক শশধর ‘শহিদ’ ছবির জন্য খারিজ করে দিলেন লতার কণ্ঠ। ক্ষুব্ধ হায়দর শশধরকে বলেছিলেন, একদিন লতাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য লাইন ধরবে সারা দেশের ইন্ডাস্ট্রি।
হ ১৯৪৮ সালে হায়দরের ‘মজবুর’ ছবিতে প্রথম বড় ব্রেক পান লতা। হিট হয় তার গলায় দিল ‘মেরা তোড়া’। লতা বলেন, হায়দর তার জীবনে গডফাদার। তিনিই প্রথম তার কণ্ঠে পূর্ণ ভরসা রাখতে পেরেছিলেন।
হ ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবিতে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গান লতাকে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এনে দেয়। হায়দরের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণ করেন তিনি। হয়ে উঠেন দেশের নাইটিঙ্গল।
হ দেশের মোট ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা। ঠিক কতগুলো গান গেয়েছেন, নিজেও সেই রেকর্ড রাখেনি।
হ ১৯৬২ সালে গুরুতর অসুস্থ লতা ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। তিন মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। অভিযোগ, তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল তার বাড়ির রাঁধুনির বিরুদ্ধে। রহস্যজনক ভাবে ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান সেই রাঁধুনি।
হ লতাই প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যিনি লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠান করেন।
হ ১৯৭২ সালে পরিচয় ছবিতে ‘বিতি না বিতাই র্যায়না’ গানের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭১ সালে পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হন তিনি। ২০০১ সালে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন এই কিংবদন্তি।
হ প্রথম দিকে লতার গানে নূরজাহানের গানের প্রভাব পাওয়া যেত। নূরজাহানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল। সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে লতার প্রিয় ছিলেন কিশোরকুমার।
হ জীবনে মাত্র একদিন স্কুলে গিয়েছিলেন লতা। শোনা যায়, তিনি ক্লাসে গান শেখাচ্ছিলেন বলে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। আবার শোনা যায়, বোন আশাকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন স্কুলে। সেখানেও আপত্তি ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের। পরে বাড়িতেই পড়াশোনা করেন লতা।
হ লতার জীবনে একটি সাধ অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। তা হল, কে এল সায়গলের সঙ্গে আলাপ করা। ক্রিকেটভক্ত লতার সঙ্গে রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। তাদের কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে দুজনেই চিরজীবন অবিবাহিত থেকে গিয়েছেন।
Leave a Reply