দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ লিবিয়া হয়ে ইতালির পথে যাত্রা করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না। লিবিয়ার ভয়ঙ্কর দালালচক্রের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, লিবিয়ার বেনগাজী থেকে জোয়ারা পর্যন্ত ১০টি শহরে বাংলাদেশি দালালদের মালিকানাধীন ৮০টিরও বেশি নির্যাতন ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। নির্যাতন করে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে নিরীহ তরুণদের হত্যা করা হয়। এমনকি অর্থ আদায়ের পর তরুণদের অন্য দালালচক্র বা স্থানীয় মাফিয়াচক্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারাও অর্থ আদায় করতে ফের নির্মম নির্যাতন শুরু করে। দালালচক্র আর মাফিয়াদের চাহিদা পূরণ করার পরের যাত্রা যেন আরও ভয়ঙ্কর। সব বাধা পেরিয়ে লিবিয়ার জোয়ারায় পৌঁছে হাওয়াই বোটে বা কাঠের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির পথে চূড়ান্ত যাত্রা শুরু হয়। যাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তারা ইতালিতে পৌঁছতে পারেন। তবে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সাগরে সলিল সমাধি ঘটে। এই অনিশ্চিত যাত্রার পথে পথে তৈরি আছে অসংখ্য মৃত্যুকূপ।
জানা গেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। স্থানীয় মাফিয়া এবং মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব ক্যাম্পে বাংলাদেশি তরুণদের আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, লিবিয়ায় অবস্থানকারী ভয়ঙ্কর ২৪ দালালের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। লিবিয়ায় একাধিক ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণকারী একজন দালাল আমাদের সময়কে বলেন, লিবিয়ায় প্রায় ৩৫ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই দালাল।
এদিকে গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে ২৬ বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় দেশে ২৬টি মামলার মধ্যে ১৫টির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা ১২ জনের মধ্যে ৯ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। মামলার তদন্ত শেষ করে এ মাসের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র। এরই মধ্যে দেশে অবস্থানকারী ৪৪ দালালকে গ্রেপ্তারও করেছে সংস্থাটি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারছি লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেক বাংলাদেশি আটকা আছেন। লিবিয়ায় অবস্থানকারী দালালদের বিষয়েও আমরা খোঁজ নিচ্ছি। এরই মধ্যে ১০/১২ জন দালালের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু করেছি। দু-একদিনের মধ্যে আমরা নাম-ঠিকানা পাঠিয়ে দেব। আরও অনেক দালালের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাদের পুরো নাম, ঠিকানা, ছবি ও পাসপোর্ট নম্বর না থাকার কারণে আপাতত রেড নোটিশ জারি করার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, আশা করছি মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে এ মাসের মধ্যেই চার্জশিট জমা দেওয়া সম্ভব হবে।
যেভাবে শুরু হয় অনিশ্চিত যাত্রা
সিআইডি সূত্র এবং ভুক্তভোগীরা জানায়, প্রথমে গ্রাম্য দালালরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক তরুণদের ইতালি পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তারা বলে ৪ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ট্যুরিস্ট ভিসায় তাদের বিমানে করে দুবাই বা শারজাতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ট্রানজিট নিয়ে পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজীতে। তবে কখনো কখনো তিউনিসিয়া হয়ে বেনগাজী পাঠানো হয়। বেনগাজী বিমানবন্দর থেকে অস্ত্রধারীরা গাড়িতে করে তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এসব ক্যাম্পে জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে আবারও ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করা হয়। ওই ক্যাম্প থেকে ত্রিপোলিতে পাঠানোর কথা বলে আরও ২ থেকে ৩ লাখ টাকা আদায় করা হয়। সেখান থেকে ইতালিতে পাঠাতে নেওয়া হয় আরও ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এ টাকা নেওয়ার পর তাদের জোয়ারা থেকে ভূমধ্যসাগরে ছোট ছোট নৌকায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে নৌকা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। দিক নির্ণয়সহ নেভিগেশন সিস্টেমও শেখানো হয়। তারপর তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এতে অধিকাংশেরই ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি ঘটে।
লিবিয়ায় অবস্থানরত দালালরা
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, লিবিয়ার বেনগাজী, আজদারিয়া, সিরত, মিশরাতা, জিলতান, তাজুরা, ত্রিপোলি, জানজুর, সুরমান এবং জোয়ারা শহরে ৮০টির বেশি নির্যাতন ক্যাম্পের মালিক বাংলাদেশি। সুরমান ও জোয়ারায় রয়েছে বড় বড় ক্যাম্প। এর কারণ জোয়ারা থেকেই ইতালির পথে নৌকা ভাসানো হয়। সুরমান শহরটি জোয়ারার কাছেই। এই নৌকা ভাসানোকে দালালরা বলে গেমিং।
লিবিয়ায় অবস্থানকারী দালালদের অন্যতম মাদারীপুরের মিরাজ হোসেন। লিবিয়ার বেনগাজী, ত্রিপোলি, জোয়ারাসহ বিভিন্ন শহরে তার ক্যাম্প রয়েছে। মাদারীপুরের কাজী ইসমাইল ওরফে কাজী আলম, শরীফ, আশরাফ, বাদশা, মনির, কালাম, কামাল, সেলিম, রুবেল, আব্দুল্লাহ, জসিম, সোহাগেরও ক্যাম্প রয়েছে বিভিন্ন শহরে। লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে দালাল হিসেবে সক্রিয়দের মধ্যে অন্যতম মাদারীপুরের রুবেল, নুরু, আতিয়ার, গোপালগঞ্জের ডেবিড ও মমিন, সিলেটের পারভেজ ও পলাশ, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির নাসির উদ্দিন রুমান ওরফে গুডলাক, তার ভাই মঞ্জুর হোসেন রিপন ও ইয়াকুব রিপন এবং কিশোরগঞ্জের তানজিরুল। তারা লিবিয়ায় মিলিশিয়া বাহিনী, সেনা, নৌ এবং কোস্টগার্ডকে হাত করেই এ ধরনের কর্মকা- করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এখন আঞ্চলিক শাসন চলছে। অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। স্থানীয় মাফিয়া এবং মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে বাংলাদেশি দালালচক্র নিরীহ তরুণদের জিম্মি করছে। অনেক সময় অপহরণের নাটক সাজিয়ে বাংলাদেশিদের তুলে দেওয়া হচ্ছে মাফিয়াদের হাতে। যে ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাদের অপহরণ করেছিল মাফিয়ারা। তাদের হত্যার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, মিলিশিয়া বাহিনীর পোশাকধারী সদস্যরাও হত্যায় অংশ নিয়েছিল।
Leave a Reply