॥ সৈয়দা সনিয়া আখতার ॥
একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। নৃশংসতাও বাড়ছে। সোনার বাংলাদেশ এখন ধর্ষকদের কবলে । এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের মতে, বিচারহীনতাই এমন ঘটনা বাড়ার কারণ। এই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পীকার নারী। অথচ এই দেশেই ধর্ষনের মহাৎসব চলছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ১ মাস আগে স্বামীকে গৃহবধূকে বেঁধে রেখে ধর্ষণের চেষ্টা এবং বিবস্ত্র করে উলঙ্গ মধ্যযুগীয় বর্বরতা নির্যাতন করা হয়েছে। অথচ ওই এলাকার কোন লোক তা জানতে পারল না। মহিলার আত্মীয়-স্বজনও কোনো প্রতিবাদ করে নাই। প্রশাসন একমাসও জানতে পারেনি। গত ৪ অক্টোবর যদি ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল না হত, তাহলে এতো বড় ঘটনা মাটিচাপা পড়ে যেত। কিন্তু ভাবতে অবাক হচ্ছি ও ভুক্তভূগি মহিলা ও তার স্বামী পরিবার কি করে সহ্য করলো এতোদিন। হয়তো ভাবছে তারা অনেক প্রভাবশালী। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। উল্টো পুরো পরিবার আবারও হয়রানীর শিকার হতে হবে। আর এ জন্য বিচার কার কাছে চাইবে? এ রকম ধর্ষণের ঘটনার প্রতিদিনেই তো হচ্ছে।
গত ৩ অক্টোবর অপহরণের পর সাতক্ষীরার এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে । এ ঘটনার সাতদিন পর খুলনা থেকে তাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। পঞ্চম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে উদ্ধারের পর খুলনার লবনচোরা এলাকা থেকে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শনিবার দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া সরকার পাড়া এলাকার মিকাইল হোসেনের ছেলে মনিরুল ইসলাম শাওন (২৮) ও আবু বাক্কার সিদ্দিকের ছেলে আসাদুল ইসলাম (৩২)। সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মির্জা সালাহউদ্দিন জানান, শনিবার ওই স্কুল ছাত্রীকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে শাওন ও আসাদুল নামের দুই যুবককে। তিনি জানান, গত ২৫ সেপ্টম্বর সাতক্ষীরা শহরের হিন্দুধর্মাবলম্বী ওই স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে খুলনার লবনচোরায় নিয়ে যায় ওই দুই যুবক। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে অটকে রাখে তারা। মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে শুক্রবার রাতে সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা করেন নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর বাবা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে এক তরুণী ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সবুজ আল সাহবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে রাতেই রাজধানীর একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগ নেতা সবুজকে ও বিবি ফাতেমা ঝুমুর (৩৫) নামে আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলায় বিবি ফাতেমাকে ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহার অনুযায়ী পুলিশ জানায়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ৬০ ফুট এলাকায় নিজ বাসায় নিয়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেন সবুজ।
এদিকে শনিবার মুন্সিগঞ্জে ৭২ বছরের এক বৃদ্ধা অজু করতে গিয়েছিলেন। অজু করে ফেরার পথে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণকারী সে কীর্তিমান পুরুষটা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। সব জায়গায় যেখানে হাত দেবেন সেখানে আওয়ামী লীগ। এত বাড়ন্ত হয়েছে এদের, এত বাম্পার ফলন হয়েছে এদের। এদের চেতনার বাম্পার ফলনের যন্ত্রণায় মা-বোন, কন্যারা কেউ নিরাপদ থাকতে পারছে না।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রবাসে স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে পুলিশ ছাত্রাবাসে গিয়ে স্বামী ও স্ত্রীকে উদ্ধার করে। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে স্বামী-স্ত্রী এমসি কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এসময় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ৫-৬ জন তাদের জোরপূর্বক কলেজের ছাত্রবাসে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে তারা। বর্তমানে ধর্ষণের শিকার তরুণী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাইয়ুম চৌধুরী জানান, এই দম্পতিকে উদ্ধার করা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এমসি কলেজের হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন জানান, শুনেছি কারা স্বামী-স্ত্রীকে আটক রাখে হোস্টেলে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ রয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে। তবে যতটুকু জেনেছি স্বামী-স্ত্রীকে কারা হোস্টেলে আটক করে রেখেছে। করোনাকালে বন্ধ থাকা অরক্ষিত ছাত্রাবাসে প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বহিরাগতের আনাগোনার পাশাপাশি মাদক সেবন ও জুয়ার আসর চলে ।
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার নগরীতে এক স্কুলছাত্রী (১৪) ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নগরীর দাড়িয়াপাড়া এলাকার একটি বাসায় নিয়ে নিজু আহমেদ (১৮) নামে এক কলেজছাত্র তাকে ধর্ষণ করেছে। এ ঘটনায় ওই স্কুলছাত্রীর মা বাদী হয়ে শুক্রবার (২ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১টার দিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নগরীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। মামলা সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত নিজু আহমদ দাড়িয়াপাড়া ১৪/বি বাসার বাসিন্দা এবং মদনমোহন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে নিজু আহমদ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং পরদিন তাকে তাড়িয়ে দেয়। পরে ওই ছাত্রী বিষয়টি তার বাসায় জানায়।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী। এরমধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায় বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংগঠনটি আরো জানায়, গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানরি কারণে ১২ নারী আত্মহত্যা করেছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হয়েছেন।
আসক জানায়, এ সময়কালে দেশে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ও এর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংগঠনটি আসক আরো জানায়, গত ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৮ নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এছাড়া স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ১২ নারী। এ সময়ের মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হন এবং ৩২ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ধর্ষনের শিকার হয়েছেন ৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। এছাড়া এ সময়কালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ নারী। শিশু নির্যাতন ও হত্যার গত ৯ মাসের পরিসংখ্যানও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ সময়কালে ১০৭৮ শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকারসহ হত্যার শিকার হয়েছে ৪৪৫ শিশু। এছাড়া ৬২৭ শিশু ধর্ষণ ও ২০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে।
২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। মানুষ হয়ে পড়ে গৃহবন্দি। তাদের মধ্যে দেখা দেয় মৃত্যুভীতি। দেশে দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ এত বাড়ে যে, আক্রান্তদের জন্য এক সময় হাসপাতালে আসন পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। এ অদৃশ্য ভাইরাসের ছোঁয়ায় কার কীভাবে মৃত্যু হয়, সে ভয়ে সবার অন্তরে কাঁপন ধরে। সাধারণ বিবেচনায় মানুষ মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়লে তাদের মনটা নরম হওয়ার কথা।
অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি খারাপ প্রবৃত্তি কাজ না করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা করোনাকালে মানব চরিত্রে এমন পরিবর্তন খুঁজে পাই না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে সমাজে যেভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, করোনাভাইরাস চলাকালীনও তা অব্যাহত রয়েছে। মানসিক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন করোনার ভ্যাকসিন তৈরি নিয়ে ব্যস্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে, অনেক দেশ করোনার ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিলেও তিন স্তরের পরীক্ষা অতিক্রম করে তা বাজারে আসতে আরও ৬-৭ মাস সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশে করোনার ওষুধ আর ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় নিয়োজিত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় একটা বাড়তি বিষয় যোগ করতে হবে; সেটি হল- করোনাভীতির সঙ্গে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা।
কারণ, সম্পর্ক না থাকলে করোনা ও মৃত্যুভীতির মধ্যে সমাজে ধর্ষণ বাড়বে কেন? দেশব্যাপী ব্যাপক হারে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটবে কেন? কেন এমসি কলেজের মতো পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসে গৃহবধূকে শিক্ষার্থী কর্তৃক গণধর্ষিত হতে হবে? কেন কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে তরুণীকে আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হবে? গাজীপুরে পুবাইলের মাঝুখানে কেন ১৫ বছরের কিশোরীকে ঘরে আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হবে?
ফেনীর সোনাগাজীতে কেন কিশোর মাদ্রাসা ছাত্রকে বলাৎকার করা হবে? বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কেন সীতাকুণ্ডে এক যুবতীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হবে? রাজশাহীতে কেন বিবাহিত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জনৈক শিক্ষানবিশ অবিবাহিত নারী আইনজীবীকে বছরাধিককাল ধর্ষণ করবেন? করোনার মধ্যে রাজশাহীর মোহনপুরে কেন ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হবে কোচিং সেন্টারের শিক্ষককে? এভাবে করোনাকালের ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের উদাহরণ দিতে থাকলে ছোট প্রবন্ধে লিখে শেষ করা যাবে না। এ জন্যই নাগরিক মনে এমন প্রশ্ন উঠেছে- করোনাভীতির কারণে কি মানুষের মধ্যে বর্ধিত যৌন উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে?
Leave a Reply