নিত্যপণ্যের বাজার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। একটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যের লাগাম ধরতে না ধরতেই আরেকটি পণ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে যাচ্ছে। যেন সুতোকাটা ঘুড়ির মতো উড়ছে। কিছুদিন আগে পেঁয়াজের ঝাঁজে অস্থির হয়ে পড়েন ভোক্তা। এর পর পরই বেড়ে যায় চালের দাম। সরকার মিলগেটে চালের দাম বেঁধে দিলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। একইভাবে রেকর্ডভাঙা আলুর দামও নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তাতেও সুফল মেলেনি। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামেই আলু বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। মূলত তদারকির অভাবেই পণ্যের লাগামছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
শুধু পেঁয়াজ, চাল কিংবা আলু নয়, স্বস্তি দিচ্ছে না সবজিও। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে সবজির দাম কয়েক দফা বাড়ছে। বাজারে ভোজ্য তেল, ডিম, মসলা, মাছ, মাংসসহ সব নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম প্রতিনিয়ত ভোগাচ্ছে ভোক্তাদের। এ চিত্র একদিন-দুদিন নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোর।
চাহিদা-জোগানের সূত্র মেনে নয়, বাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করছে সিন্ডিকেটের ইশারায়। প্রতিবছরই সিন্ডিকেট করে অসাধু দুষ্টুচক্র নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়ে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অথচ যে কোনো নিত্যপণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে বাজার তদারকিতে বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের পক্ষে নানা সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ঘুরেফিরে সেই পুরনো সিন্ডিকেটের কারসাজির তথ্যই উঠে আসছে সামনে।
পণ্যের দাম নিয়ে বরাবরের মতো একে অন্যকে দোষারোপ করছেন খুচরা, পাইকার ও আড়তদাররা। আড়ালে পকেট ভারী করছে কারসাজিবাজরা আর বাজারে লুট হচ্ছে ভোক্তার কষ্টার্জিত অর্থ। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার তদারকিতে সরকারের নানা সংস্থা কাজ করলেও
এ কাজে বড় ধরনের গলদ থেকেই যাচ্ছে। বাজার তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তদারকি হচ্ছে, তবে সেটা গাছাড়া। যার খেসারত গুনতে হচ্ছে নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের। বাজার নিয়ন্ত্রণে নিবিড় তদারকি হওয়া দরকার। কিন্তু তা কখনই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হলে তা কেন হচ্ছে, কারা করছে, কীভাবে করছে তা খুঁজে বের করতে হবে। সে অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি আমাদের সময়কে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটর করছে ভোক্তা অধিদপ্তর। পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। এখন তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে হঠাৎ করে আলুর দাম বেড়ে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিসিবিও সহায়তা করছে। আসলে বন্যার কারণে বাজারে কিছুটা প্রভাব রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সুশাসনের অভাবে সুযোগ পেলেই একশ্রেণির আড়তদার বা বড় ব্যবসায়ী প্রতিবছর চাল, পেঁয়াজসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। দেশে এসব পণ্যের যথেষ্ট মজুদ থাকার পরও দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি মুক্তবাজারের বৈশিষ্ট্য নয়। এদের চিহ্নিত করতে হবে আগে।
গত বছর এ সময়ে প্রতি কেজি আলু ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হতো, সেই আলু কয়েক দিন আগেও রেকর্ড ভেঙে বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকায়। সরকার সর্বশেষ খুচরায় প্রতি কেজি আলুর দাম ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও কোথাও সে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। টিসিবির ট্রাকে ২৫ টাকায় মিললেও বাজারে এখনো আলুর কেজি ৪৫ টাকা। অন্যদিকে অনেক আড়তে পাইকারি ব্যবসায়ী এখনো ‘আলু নেই’ নোটিশ ঝুলিয়ে রাখছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ লাখ ৯ হাজার টন। বাংলাদেশে গত আলুর মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। গত বছর উৎপাদিত আলু থেকে প্রায় ৩১ লাখ ৯১ হাজার টন আলু উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিছু পরিমাণ আলু রপ্তানি হলেও ঘাটতির আশঙ্কা একেবারেই ক্ষীণ।
চালের দামও নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার প্রতি কেজি সরু মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা ও প্রতি ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকা; আর মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা ও বস্তা ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু খুচরায় এর কোনো প্রভাব পড়েনি। রাজধানীর খুচরা বাজারে মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬০, আটাশ ৫২ থেকে ৫৬ ও মোটা চাল ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ানবাজারের চালের পাইকার মো. মোশারফ হোসেন বলেন, সব মিলগেটে সরকারি দাম মানা হচ্ছে না। আমাদের এখনো বাড়তি দামে চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পাইকারিতে এখন মিনিকেটের বস্তা (৫০ কেজি) ২ হাজার ৭৫০ থেকে ২ হাজার ৮৫০ টাকা, আটাশের বস্তা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৬৫০ ও মোটা চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়।
মিল মালিকরা সরবরাহ সংকটের কথা বললেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছর আমন মৌসুমে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল; তা অর্জিত হয়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও সেপ্টেম্বরে অনেক ভুগিয়েছে পেঁয়াজ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে আমদানি বন্ধের খবরে দেশের বাজারে রাতারাতি লাফিয়ে বাড়ে পেঁয়াজের দাম। এ সময় ১৩০ টাকাতেও বিক্রি হয় পণ্যটি। এখনো নাগালের বাইরে রয়েছে দাম। খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়।
সবজির দামেও যেন আগুন লেগেছে। ৫০ টাকার নিচে পেঁপে ও কাঁচাকলা ছাড়া আর কিছুই মিলছে না। অধিকাংশ সবজির দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। এ ছাড়া শিম, বেগুন, উচ্ছে, পাকা টমেটো, গাজরের দাম রয়েছে শতকের ওপর। কাঁচামরিচের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়।
বৃষ্টি-বন্যার দোহাই দিয়ে সরবরাহ সংকটের কথা বলছেন সবজি ব্যবসায়ীরা। অথচ সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবার খরিফ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমি। সেখানে এবার ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অন্তত ১০২ শতাংশ বেশি।
অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক ড. আলহাজ উদ্দিন আহাম্মেদ আমাদের সময়কে জানান, খরিফ মৌসুমে যদিও সবজি উৎপাদন কম হয়। তার ওপর বৃষ্টিপাত হলে উৎপাদন আরও কমে যায়। তার পরও বর্তমানে সবজির যে উৎপাদন রয়েছে, তাতে বাজারের চাহিদার বিপরীতে সবজির ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।
বাজারদরে অস্থিরতার বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ইউসুফ আমাদের সময়কে বলেন, পেঁয়াজের মূল্যটা নির্ধারণ করতে আমাদের আমদানি করা মূল্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটা ছাড়া আমরা সেভাবে নির্ধারণ করতে পারি না। চালের দাম এখন মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। আর আলুটা দাম কয়েক দিন আগে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। হিমাগার থেকে বাজারে আসার জন্য আমাদের একটু সময় দিতে হবে।
পণ্যের দামে কারচুপি ঠেকাতে বাজারে মূল্যতালিকা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তালিকায় দাম লেখা থাকলেও পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মর্জিমতো। আর তালিকার দামে পণ্য কিনতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন ক্রেতারা। তারা বলছেন, অধিকাংশ বাজারে মূল্যতালিকা মানা হয় না। নামিদামি বাজারে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ বাজারে কী দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই।
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাজধানীর সাতটি বাজারে স্থাপন করা হয়েছে ডিজিটাল মূল্যতালিকা। এর একটি রয়েছে হাতিরঝিল বাজারে। গতকালও বাজারটিতে গিয়ে দেখা গেছে, মূল্যতালিকাটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। বাজারে আসা ক্রেতারা বলেন, অনেক দিন ধরেই কাজ করছে না তালিকা। কেউ ঠিক করতেও আসেনি এটা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মো. আবু নাছের জানান, বর্তমানে দুটি ডিজিটাল মূল্যতালিকা বিকল রয়েছে। সারাদিন চালু থাকার ফলে সার্কিট ডাউন হয়েছে। দ্রুতই এগুলোকে মেরামত করা হবে।
সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও সমন্বয়ের অভাবে তার ফল ভোগ করা যাচ্ছে না বলে জানান কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে দাম নির্ধারণ করাসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা সরকারের এমন পদক্ষেপে আস্থা রাখতে চাই। তবে সমস্যার গোড়ায় নজর দিতে হবে আগে। পণ্যের বাজার মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে খুচরা বাজারের চেয়ে হিমাগার পর্যায়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয় থাকতে হবে।
Leave a Reply