নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন “গ্রাম হবে শহর” শতভাগ বাস্তবায়ন করতে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সেবা দানের জন্য সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ। তাই ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের বিষয়টি বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান বিবেচনায়। এজন্য ইউনিয়ন পরিষদকে দিতে হবে ক্ষমতা ও আর্থিক স্বাধীনতা। যার জন্য প্রয়োজন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জনগণের বাস্তব অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
সে লক্ষ্যে দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রথম শুরু হয় ‘সিরাজগঞ্জ লোকাল গভর্ন্যান্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড প্রজেক্ট (এসএলজিডিএফপি) পাইলট প্রকল্প’। ওই পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকল্পের সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ২০১১ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত ‘দ্বিতীয় লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি-২) বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের একাউন্টে সরকারের থোক বরাদ্দ দিয়ে স্থানীয় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ পরিষদের জবাবদিহিতা ও কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের জনগনের মধ্যে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এলজিএসপি-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদী এলজিএসপি-৩ প্রকল্প। যা শেষ হবে আগামী ২০২১ সালের জুন মাসে। ব্যতিক্রম এ প্রকল্পের উন্নয়নের ছোয়ায় ইতোমধ্যে পাল্টে যেতে শুরু করেছে একসময়ের অবহেলিত গ্রামীণ জনপদ। যার সুফলভোগ করতে শুরু করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদকে এলজিএসপি কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার পাঁচশ’ ৩৫ কোটি টাকা। যারমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের তিন হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তা বাবদ দুই হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। তারই ধারাবাহিকতায় বরিশাল জেলার দশ উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এলজিএসপি-৩ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী গ্রামীণ এলাকায় নির্মিত হচ্ছে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ, বাজার উন্নয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা, পানি, স্যানিটেশন, কমিউনিটি ক্লিনিক মেরামত, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানান উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড। এসব উন্নয়নের ফলে ইতোমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে অতীত সরকারের সময়ে অবহেলিত গ্রামীণ জনপদের পুরনো চেহারা। প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ডিজিটাল মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, এলজিএসপি’র বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে পার্বত্য শান্তি চূক্তি বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ কমিটির আহবায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র দিকনির্দেশনায় প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে উন্মুক্ত জনসভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় ব্যাপক নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে জনগনের চাহিদা অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহন করা হয়। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে মাহিলাড়া ইউনিয়নে এলজিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে জনগনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৭১ লাখ ২৬ হাজার ৫২৩ টাকা ব্যয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ খালের উপর ১১টি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়াও বরাদ্দের অর্থ দিয়ে এ্যাপ্রোচ সড়ক, ইট সলিং, কমিউনিটি ক্লিনিক মেরামতসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড জনগনের কাছে জবাবদিহিতার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যার সুফল ভোগ করছে তৃণমূলের বাসিন্দারা।
সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ ফারুক হোসেন মোল্লা জানান, এলজিএসপি প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ইতোমধ্যে রাস্তা নির্মাণ, ব্রিজসহ ছোট-বড় অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে প্রত্যন্ত সরিকল ইউনিয়নবাসী। এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের জেলা পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা জেলা সহায়ক (ডিএফ) মোঃ মিজানুর রহমান জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই কিস্তিতে জেলার দশ উপজেলার ৮৮টি ইউনিয়ন পরিষদের অনুকূলে মোট ১৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা পরিষদের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে বাস্তবায়িত স্কীমগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসনের দিক নির্দেশনায় সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব নম্বরে বরাদ্দের টাকা জমা থাকলেও স্কীম শতভাগ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের অনূকূলে বিল প্রদান করছেনা কোন ইউনিয়ন পরিষদ।
বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, স্থানীয়ভাবে এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা করে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের ব্যাংক হিসাবে মৌলিক থোক ও দক্ষতা ভিত্তিক অনুদান বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করাসহ পরিষদের আর্থিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকরী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করা হয়েছে। ফলে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা জনগনের কাছে জবাবদিহিতার আওতায় এসেছে। এছাড়াও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব সক্ষমতা, আয় বৃদ্ধি ও নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও জানান, নির্ধারিত শর্তপূরণের মাধ্যমে প্রতিবছর জেলার ইউনিয়ন পরিষদসমূহকে এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের আওতায় সরাসরি বরাদ্দ প্রদান করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ওয়ার্ড সভায় স্থানীয় জনগনের অংশগ্রহণে চাহিদা অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কীম গ্রহণ, ওয়ার্ড কমিটি ও স্কীম সুপারভিশন কমিটি গঠণের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা তৈরি করে স্কীম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উম্মুক্ত বাজেট সভার মাধ্যমে জনগণের সামনে পরিষদের আয়, ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।
এছাড়াও প্রকল্পের সকল বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালকের কাছে ষান্মাসিক প্রতিবেদন দাখিল করে প্রকল্পের শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। অপরদিকে প্রকল্পের অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য জিপিএস লোকেশনসহ ওয়ার্ড সভার ছবি, স্কিম বাস্তবায়নের পূর্বের, চলমান ও পরের ছবি এমআইএস সফটওয়্যারে আপলোড করার কারনে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে পারছেন সাধারণ জনগণ। এছাড়াও বেসরকারি অডিট ফার্ম ও সরকারি অডিটরদের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রকল্পভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সমস্ত কার্যক্রম অডিট করা হচ্ছে। ফলে এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদকে সরাসরি বরাদ্দ দেয়া হলেও জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিষদের দায়বদ্ধতা সরকার ও জনগণের কাছে নিশ্চিত করা হয়েছে।
Leave a Reply