মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশের একদল গবেষক। তাদের দাবি, ‘এলট্রোম্বোপ্যাগ’ নামের জেনেরিক ওষুধের (ট্যাবলেট) স্বল্পমাত্রার ডোজ দিয়ে ডেঙ্গুর সময় রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) বাড়াতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধে সাফল্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে ওষুধটি তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তারা। চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম নুরুন নবী এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। এ ছাড়া প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সজীব চক্রবর্তী গবেষণাকর্মটি সার্বিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। একই সঙ্গে ঢাবি ও ঢামেকের গবেষকরা এতে অবদান রাখেন। গবেষণার সার্বিক সহায়তা দিয়েছে ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডেঙ্গু চিকিৎসায় এলট্রোম্বোপ্যাগ ওষুধ ব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে এ গবষেণা চলানো হয়। এ সময় ১০১ জন রোগীর ওপর গবেষণা চালান গবেষকরা। এতে দেখা গেছে, এলট্রোম্বোপ্যাগ ওষুধ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। এলট্রোম্বোপ্যাগ শুরুতে শুধু ইমিউন থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা ক্রনিক লিভার ডিজিসজনিত অণুচক্রিকা স্বল্পতা সংশোধনে প্রয়োগ করা হতো। তবে উপসর্গজনিত মিল থাকায় পরবর্তীতে ডেঙ্গুজনিত অণুচক্রিকা স্বল্পতা সমাধানে এর কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য এ গবেষণাটির পরিকল্পনা করা হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ধরনের কৌশলকে ‘ড্রাগ রিপারপজিং’ বা ‘রিপ্রোফাইলিং’ বা ওষুধের কাজের পুনর্বিন্যাস বলা হয়। যেখানে একটি ওষুধকে তার মূল প্রয়োগ ক্ষেত্রের বাইরে ব্যবহার করা হয় আরেকটি কাছাকাছি উপসর্গের রোগ নিরাময়ে।
গবেষকরা রোগীদের দুই দলে ভাগ করে ২৫ ও ৫০ মিলিগ্রামের এলট্রোম্বোপ্যাগ প্রয়োগ করেন। এর মধ্যে ২৫ মিলিগ্রাম এলট্রোম্বোপ্যাগ গ্রহণকারীরা বেশি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছেন। এ ছাড়া দুই দলেরই ৯১ শতাংশ রোগী যথাসময়ে রক্তে স্বাভাবিক প্লাটিলেটের মাত্রা ফিরে পেয়েছেন। ফলে আলাদা করে প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে।
এতে আরও বলা হয়, গবেষণা চলাকালীন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, বেটার লাইফ হাসপাতাল ও এএমজেড হাসপাতাল থেকে পরিকল্পনামাফিক ডেঙ্গু রোগীদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরে তাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করে দুটি গ্রুপকে দুটি ভিন্ন মাত্রায় এলট্রোম্বোপ্যাগ দেওয়া হয়। এ সময় একটি গ্রুপকে রাখা হয়েছিল কন্ট্রোল হিসেবে। ওষুধ প্রদানের একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর রোগীদের অণুচক্রিকার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এ সময় পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে
দেখা যায়, ওষুধপ্রাপ্ত দুটি গ্রুপেই শতকরা ৯১ শতাংশ রোগী যথাসময়ে স্বাভাবিক অণুচক্রিকার মাত্রা ফিরে পান, যেখানে কন্ট্রোল গ্রুপে ৫৫ শতাংশ রোগী ওই সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক মাত্রা অর্জন করেন।
এ ছাড়া বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে প্রত্যেক গ্রুপের রোগীদের অপরিপক্ব অণুচক্রিকার মাত্রা নির্ণয় করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ওষুধপ্রাপ্ত দুটি গ্রুপে কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় উচ্চমাত্রায় অপরিপক্ব অণুচক্রিকার উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা এর অণুচক্রিকা স্বল্পতা নিরাময়ে কার্যকারিতার প্রমাণ দেয়। এ সময় ওষুধপ্রাপ্ত দুটি গ্রুপে আলাদা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ দ্বিতীয় ধাপের গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ডেঙ্গুজনিত অণুচক্রিকা স্বল্পতা নিরাময়ে এলট্রোম্বোপ্যাগের প্রয়োগ কার্যকর ও নিরাপদ। গবেষণালব্ধ ফল এ ওষুধটি নিয়ে পরবর্তীতে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া এটি দৃঢ়ভাবে ডেঙ্গু নিরাময়ে কার্যকারিতা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
Leave a Reply