ডিফেন্সিভ (গা বাঁচানোর) মুডেই ভঙ্গি কেটে গেল বিএনপির আরেকটি বছর। রাজনীতির মাঠে বড় কোনো কর্মসূচি ছিল না বছরটিতে। তার ওপরে মারামারি করোনা ব্যাহত করেছে দলটির স্বাভাবিক ও দিবসভিত্তিক কর্মসূচি। আসছে নতুন বছরে মাঠের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটি আরো সঙ্ঘবদ্ধ হতে চায়। চিন্তা রয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে নানা কর্মসূচির। পাশাপাশি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জোরালো করার কথাও বলেছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
২০২০ সালে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর ছিল চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়ার আগে ২৫ মাস কারান্তরীণ ছিলেন বিএনপি প্রধান। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার মুক্তির দাবিতে মাঠের কর্মসূচিসহ দলটি আইনি নানা তৎপরতার দ্বারস্থ হলেও কোথাও কোনো ঠাঁই পায়নি। নেত্রীর মুক্তি ইস্যুতে শক্ত কোনো কর্মসূচি না থাকায় তৃণমূলের নেতারাও ছিলেন ক্ষুব্ধ। অবশেষে করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে অসুস্থ বেগম জিয়াকে মুক্তি দেয় সরকার। এই মুক্তির মধ্য দিয়ে স্বস্তি মেলে বিএনপি নেতাদেরও।
খালেদা জিয়াকে প্রথম দফায় ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বরে সময় আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। তিনি এখন গুলশানের বাসায় রয়েছেন। মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তাকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া মুক্ত নন। তাকে গৃহ অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাও নিতে পারছেন না।’
করোনা মহামারীর প্রকোপ চলতে থাকায় বছরের প্রায় পুরো সময় দিবসভিত্তিক দলীয় কর্মসূচিতে সময় কাটিয়েছে বিএনপি। করোনার কারণে মাঠের রাজনীতি না থাকায় বেশ কিছু আলোচনা সভা হয়েছে ভার্চুয়ালি। ‘বিএনপি কমিউনিকেশন’ এসব আলোচনা সভার আয়োজন করে। দলটির স্থায়ী কমিটির সাপ্তাহিক সভাও এখন হচ্ছে অনলাইনে। প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। নেতৃত্বে মা খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি তিনি সামাল দিচ্ছেন বেশ দক্ষতার সাথেই। দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সাথে একটি শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন তিনি, যার মাধ্যমে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। গত ২০ নভেম্বর তারেক রহমানের ৫৬তম জন্মদিন পালন করেছে বিএনপি।
করোনার কারণে ২৫ মার্চ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ছিল বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। একাদশ সংসদ নির্বাচনের অনাকাক্সিক্ষত ফলাফলের পর থেকেই নতুন করে সংগঠন গোছানোর কার্যক্রম শুরু করে বিএনপি। এই সময়ে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলে নতুন নেতৃত্ব আসে। এ বছর যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির কলেবর বাড়ানো হলেও দুইটি কমিটি এখনো আংশিক অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু জেলা-উপজেলায় নতুন কমিটি করেছে দলটি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। ৪০টির বেশি পদ শূন্য হয়ে আছে। গত বছরের ১৯ জুন দুইটি শূন্য পদে সিনিয়র নেতা সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে নিয়োগ দেয়ার পরেও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির এখনো তিনটি পদ ফাঁকা রয়েছে।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে ৫০২ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে পুনরায় সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় বলেছিলেন, সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু কাউন্সিলের অংশ। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আপাতত কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কোনো চিন্তা নেই বিএনপির। এক দিকে করোনা মহামারী, অন্য দিকে খালেদা জিয়া গৃহ অন্তরীণ থাকায় এটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরবর্তী কাউন্সিলের আগে কিছু কিছু শূন্য পদে নিয়োগ দিতে পারেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
করোনা মহামারীর মধ্যেই গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। অবশ্য পরবর্তী বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে দলটি অংশ নিয়েছে। স্থানীয় সব নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে বিএনপি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। তবে পরে এই সিদ্ধান্তে তারা পরিবর্তন আনে। জানা গেছে, নির্বাচনকে ধীরে ধীরে ইস্যুতে পরিণত করতে আগামীতেও সব নির্বাচনে দলটি অংশ নেবে। সেই পরিকল্পনা থেকেই সবশেষ অনুষ্ঠিত ঢাকা-৫ ও ঢাকা-১৮সহ কয়েকটি উপনির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়া দিগন্তকে বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নতুন জাতীয় নির্বাচনের দাবি বারবার তুলে ধরছি। নতুন বছরেও এই দাবি জোরালো করতে যেটুকু স্পেস আছে, সেটুকু কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হবে।
তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলেছে। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তারা গণতন্ত্রের লেবাসে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন বছরেও এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে বিএনপি। এর সাথে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রও জড়িত রয়েছে বলে দলটির অভিমত। ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে শুরুতে বিএনপি জোটে দ্বিমত থাকলেও নানামুখী চাপে তারা শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়। দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেক নেতা ওই নির্বাচনের আগেই মনে করতেন, তাদের কয়েকটি আসন ধরিয়ে দেয়া হবে। নবম সংসদের সেই নির্বাচনে বিএনপি জোট ৩০টি আসন লাভ করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার পটভূমিতে নিরপেক্ষ একটি ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের দাবি দীর্ঘ আন্দোলনের পরেও পূরণ না হওয়ায় দশম সংসদের জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে দলটি বয়কট করে। ওই নির্বাচন বিএনপিসহ আরো ২৮টি রাজনৈতিক দল বয়কট করলেও পরবর্তী আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কৌশলী কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তারা উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয় এবং একপর্যায়ে বিরোধী শক্তিকে উল্টো চাপে ফেলে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগে ২০১৮ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাবরণ করেন সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া বিহীন নির্বাচনী মেরুকরণে শত বিপত্তি উপেক্ষা করেই নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট। এ নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন লাভ করে তারা।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতার বক্তব্য অনুযায়ী পরপর তিনটি নির্বাচনে এমন অনাকাক্সিক্ষত ফলাফলের পর স্বাভাবিকভাবেই দলটির নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েন। তবে সেই পরিস্থিতি তারা আবার কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। সংগঠনকে নতুন করে শক্তিশালী করা হচ্ছে। শিগগিরই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, এমন আশা তারা নেতাকর্মীদের মধ্যে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলছেন। করোনা মহামারী কেটে গেলে মাঠের রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা আরো বাড়বে।
নতুন বছরব্যাপী ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনাড়ম্বরপূর্ণভাবে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। কর্মসূচির মধ্যে থাকবে বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা, অঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্র প্রদর্শনী, বিষয়ভিত্তিক প্রকাশনা যেমন- গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈদেশিক নীতি, সমাজতন্ত্র থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিএনপির ভূমিকা, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমানের কর্মসূচিভিত্তিক কর্মশালা, বিএনপি শাসনামলের সাফল্য, পুস্তিকা প্রকাশ, লিফলেট বিতরণ, ডকুমেন্টারি নির্মাণ, নৃত্যনাট্য, পথনাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনে বিএনপির ভূমিকা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শন, দেশ গঠনে জিয়ার ১৯ দফার ভূমিকা, সেনাবাহিনীকে আধুনিক বাহিনীতে রূপান্তর, শহীদ জিয়ার উন্নয়নের রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা সভা এবং ছয়টি বিষয়ভিত্তিক প্রকাশনা। মহানগর-জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, সমাবেশ ও র্যালিও রয়েছে কর্মসূচিতে।
গত ১ নভেম্বর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১১৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। সাত সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটিও করে দলটি। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা হলেনÑ স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আবদুস সালাম।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী পালনে ২০২১ সালজুড়েই নানা কর্মসূচি থাকবে। আমাদের মূল থিম থাকবে, আমরা বর্তমান বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় ফিরিয়ে নিতে চাই এবং সেই চেতনাকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
Leave a Reply