আমন ধান উঠছে। আমনের এই মৌসুমে চালের দাম কমার কথা। কিন্তু উল্টো হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। মিল থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সর্বত্রই চালের দাম সপ্তাহে বেড়েছে কেজিপ্রতি কম হলেও তিন টাকা। এ দিকে বাজারে শীতের সবজির দাম কমলেও বেড়েছে নতুন আলু আর ডিমের মূল্য।
কামরুল নামে এক খুচরা বিক্রেতা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, মোটা চাল বস্তায় বেড়েছে ১০০ টাকা। আর সরু চাল বস্তায় দেড় থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে এই দাম বেড়েছে বলে কামরুল জানান। কামরুল চালের ব্যবসা করে মফস্বল শহরে। তবে ঢাকার বাজারে চালের দাম গতকাল কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বেড়েছে বলে একাধিক ক্রেতা জানিয়েছেন।
সাজ্জাদ মাহমুদ খান নামে এক সাংবাদিক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘দেশে কি এমন মহাবিপ্লব ঘটে গেল যে, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চাল প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে গেল! এই অন্যায়-অনিয়ম-নষ্টামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মানুষ কী সত্যিই ফুরিয়ে গেছে?
দেশের ৯০ ভাগ মানুষ আমার মতো ভাত খেয়ে বাঁচে। তাদের ডায়েট-পুষ্টি বিচার করার সুযোগ সামর্থ্য নেই। এই সামর্থ্যহীন মানুষদের দু’বেলা ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া ছাড়া প্রতিবাদ করার মতো গলার জোরালো কণ্ঠ কিংবা শরীরে শক্তি নেই। সত্যিই কি আমরা সামর্থ্যহীন?
এ দিকে ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ নেই। আমনের কম উৎপাদন, বাজারে ধানের আমদানি কম, দফায় দফায় বন্যায় ক্ষতিসহ নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারা দোষ দিচ্ছেন পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর, আর পাইকারি বিক্রেতারা দুষছেন মিল মালিকদের। মিল মালিকরা বলছেন ধানের বাজার চড়ার কথা। কিন্তু ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। এক দিনে হঠাৎ করে ৩-৫ টাকা কিভাবে প্রতি কেজিতে বাড়ে তা নিয়ে ক্রেতাদের প্রশ্ন। আবিদ নামে এক ক্রেতা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, হঠাৎ করে এক দিনে কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়ে গেছে সরু চালের দাম। বুঝেই উঠতে পারছেন না এটা কিভাবে সম্ভব! আবিদ বলেন, সবই হচ্ছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। যে ব্যবসায়ী এক মাস আগে চাল দোকানে তুলেছেন তিনি তো আর পাইকারি আড়ত থেকে বেশি দামে চাল কেনেননি। তার দোকানে চালের দাম বেড়েছে কেন?
বাজারে শীতের সবজির দাম কম থাকলেও বেড়েছে নতুন আলু ও ডিমের দাম। গতকাল কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে শীতের সবজি এখন মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে। অধিকাংশ সবজি এখন ২০-৩০ টাকার মধ্যে কেনা যায়। মাঝারি আকৃতির একটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধা কপিও। শিমের দাম ২০-২৫ টাকার মধ্যে। তবে বিচিওয়ালা শিম একটু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাকা টমেটোর দাম এখনো ১০০ টাকাই আছে। নতুন আলুর দাম কমে দুই দিন আগেও ছিল কেজি ৪৫ টাকা। গতকাল তা বেড়ে আবারো ৬০ টাকা হয়েছে। পুরনো আলু এখনো বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই দামে কোথাও আলু বিক্রি হয় না।
এ দিকে গত সপ্তাহেও ১০০ টাকায় ১৫টি ডিম পাওয়া যেত। গতকাল ১০০ টাকা বিক্রি হয়েছে ১৩টি। মানিকনগর বাজারের এক ডিম বিক্রেতা বলেন, মাঝে ১০০ ডিম ফার্ম থেকে ৬০০ টাকায় কেনা যেত। এখন প্রায় ৭০০ টাকা কেনা লাগে। তবে কিছু কিছু ফার্মের ডিমের মূল্য একটু চড়া। ওগুলো এখন ১০০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে।
পেঁয়াজ এখনো মানুষকে উচ্চমূল্যেই কিনতে হচ্ছে। বাজারে ভালো পেঁয়াজ এখনো ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতকাল কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে ৬০-৮০ টাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনছেন ভোক্তারা। বড় আকৃতির আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০ টাকায় পাওয়া যায়। কাঁচা মরিচের দাম কিছুটা কমে এখন ১০০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজুমার্স সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বাজার মনিটরিং ভেঙে পড়েছে। যে কারণে বাজারের এই অবস্থা। চাইলেই যে কেউ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেটের সাথে সরকারের ওপর মহলের লোকজন জড়িত। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে পলিসি ঠিক করে। জনগণের জন্য নয়। সরকারই এই সিন্ডিকেটকে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছে। পলাশ মাহমুদ বলেন, বাজার মনিটরিং জোরদার করা হলে এভাবে রাতারাতি পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব হতো না।
রাজশাহীতে বেড়েছে চাল ও তেলের দাম
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীর বাজারে গত কয়েক মাস ধরেই সবজির দাম ছিল চড়া। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই কমেছে সবজির দাম। এখন সবজির বাজার স্থিতিশীল হলেও বেড়েছে চাল ও তেলের দাম। গতকাল শুক্রবার নগরীর সাহেব বাজার ও লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটার প্রতি ১৮ টাকা। আর খোলা তেলের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আগে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের দাম ছিল লিটার প্রতি ১০০ টাকা করে। তবে এখন সেই দাম বেড়ে হয়েছে ১১৮ টাকা। আর খোলা তেলের দাম লিটার প্রতি ১০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে।
তেলের পাশাপাশি দাম বেড়েছে বিভিন্ন চালেরও। কোনো কোনো চাল কেজি প্রতি ২ টাকা থেকে শুরু করে ৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। আঠাশ ও মিনিকেট চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ টাকা করে বেড়ে হয়েছে ৫৪ টাকা এবং ৫৮ টাকা। আতপ চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২ টাকা করে। মোটা আতপ চাল এখন ৫০ টাকা এবং কাটারি আতপ ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বাসমতি এবং জিরাশাল চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২ টাকা করে। বাসমতি ৬০ টাকা এবং জিরাশাল ৫৬ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এখনো অপরিবর্তিত আছে সবজির দাম। গত সপ্তাহের মতো শিম ও শসা ৪০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। মরিচ ১২০ টাকা, করলা ৫০ টাকা, টমেটো ৬০ টাকা, পটল ৪০ টাকা, বেগুন ২০ টাকা, গাজর ৪০ টাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই সপ্তাহে কিছুটা দাম বেড়েছে নতুন আলুর। গত সপ্তাহে নতুন আলু ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
নগরীর একাধিক চাল ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাই খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। পাইকারি বাজারে দাম কমলে খুচরা বাজারেও দাম কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। ক্রেতারা বলছেন, সবজির দাম আগে অনেক বেশি ছিল, এখন সেটা কমেছে। তবে চাল আর তেলের দাম বেড়েছে। এখন চাল ও তেলের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বলেও মনে করেন তারা।
Leave a Reply