তৈরী পোশাক কারখানার শ্রমিকরা আবার নগদ অর্থে বেতন গ্রহণপ্রক্রিয়ায় ফিরে যাচ্ছেন। এর আগে সরকারি প্রণোদনা থেকে বেতন পাওয়ার জন্য শ্রমিকরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন নিলেও সেই হার হ্রাস পেতে শুরু করেছে। যেমনÑ চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক ৩৭ শতাংশ কারখানা ডিজিটাল পদ্ধতিতে শ্রমিকদের বেতন প্রদান করত, যেখানে ওই মাসে ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক নয় এমন ২০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন দিত। মে মাসে গার্মেন্ট খাত সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ার পর শ্রমিকদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের প্রবণতা বেড়ে ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক কারখানার জন্য হয় ৮৫ শতাংশ এবং ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক নয় এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য হয় ৫৭ শতাংশ। ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক কারখানাগুলোর ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের হার ছিল জুন মাসে ৮৫ শতাংশ, জুলাই মাসে ৮৭ শতাংশ, আগস্ট মাসে ৭৬ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৭৩ শতাংশ। অপর দিকে ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক নয় এমন কারখানার ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের হার জুন মাসে ছিল ৬০ শতাংশ, জুলাই মাসে ছিল ৫৪ শতাংশ, আগস্ট মাসে ছিল ৪৫ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের বেতনের আধুনিকীকরণ প্রবণতাবিষয়ে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব মূল্যায়ন করতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও মাইক্রো ফাইন্যান্স অপরচুনিটিজ (এমএফও) গত এপ্রিল থেকে ১৩৭৭ জন শ্রমিকদের ওপর ধারাবাহিকভাবে জরিপ চালিয়ে আসছে।
প্রতি সপ্তাহে একই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়, তবে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা সামান্য পরিবর্তিত হয়। জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকরা চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত আছেন। অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ নারী, যেটি পুরো গার্মেন্ট খাতের জেন্ডার বণ্টনের প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
এই জরিপের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত উপাত্তগুলো নিয়ে ‘বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের বেতনের আধুনিকীকরণ প্রবণতা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। জরিপে শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা কোন কারখানায় কর্মরত আছেন, কত বেতন পাচ্ছেন এবং কোন উপায়ে অর্থাৎ নগদ অর্থ নাকি ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন পেয়েছেন। সমীক্ষা প্রতিবেদনে কারখানাগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে: ‘ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক’ এবং ‘ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক নয়’। যেসব কারখানা সরবরাহকারী হিসেবে কোনো ব্র্যান্ডের পোশাক রফতানির জন্য তালিকাভুক্ত অথবা ব্র্যান্ডের সরবরাহকারী হিসেবে ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’ ওয়েবসাইট বা ‘ওপেন অ্যাপারেল রেজিস্ট্রি’ ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত সেসব কারখানাগুলোকে ‘ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সমীক্ষায় সাধারণ প্রবণতা হিসেবে দেখা গিয়েছে যে চলতি বছরের মে মাসে শ্রমিকদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে এবং পরবর্তী মাসগুলোতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে এসেছে। চলতি বছরের মে মাসের আগে কিছু কারখানা বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজড হয়েছিল, কিছু কারখানা সাময়িক সময়ের জন্য ডিজিটালাইজড হয়েছিল। আর কিছু কারখানা কখনোই ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে বেতন প্রদান করেনি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে চলতি বছরের মে মাসের পূর্বে ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক কারখানাগুলো এগিয়ে ছিল। একইসাথে মে মাসের পর থেকে ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের হার বৃদ্ধির প্রবণতাও ব্র্যান্ডকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে তুলনামূলক অনেক বেশি ছিল।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য গার্মেন্টস খাতে প্রদেয় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ কারখানাগুলোকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। তবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের অনেক সুবিধা যেমনÑ নগদ অর্থে বেতন প্রদান সংক্রান্ত খরচের উল্লেখযোগ্য হ্রাস, নগদ অর্থে বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে যে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকত তা দূর হওয়া, নগদ অর্থে বেতন সংগ্রহের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যে উৎপাদনের সময় অপচয় হতো তা দূর হওয়া ইত্যাদি সত্ত্বেও কারখানাগুলো আবার নগদ অর্থে বেতন প্রদানের দিকে ফিরে যাচ্ছে।
জরিপে বলা হয়েছে, এর একটি ব্যাখ্যা হলো কারখানাগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের সুবিধাগুলো দ্রুত বুঝতে পারছে না, কারণ অনেক কারখানায় তাদের সম্পূর্ণ বেতন প্রদানের পদ্ধতি নগদ অর্থ থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিবর্তন করেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিছু পোশাকশ্রমিক জানিয়েছেন তারা নিয়মিত বেতন ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেলেও ঈদবোনাস নগদ অর্থে পেয়েছেন। কারখানাগুলোর নগদ অর্থে বেতন প্রদানের দিকে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি কারণ হলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিকদের অনীহা। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রে ক্যাশ আউটের চার্জ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ধারণার অভাব, মোবাইল না থাকা, স্বামীর নামে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকায় উপার্জিত অর্থ ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ কমে আসা ইত্যাদি বিষয়কে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেতন গ্রহণের ক্ষেত্রে অনীহার কারণ হিসেবে শ্রমিকরা চিহ্নিত করছেন।
সানেম এবং এমএফওর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই জরিপগুলো ‘গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরিজ’ শীর্ষক প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক পোশাক সরবরাহ ও উৎপাদক দেশগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা, আয়, ব্যয় এবং অন্যান্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিয়মিত, নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সরকারি নীতি, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায় এবং কারখানা ও ব্র্যান্ডের মাধ্যমে পোশাকশ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করা।
প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা মাইক্রোফাইন্যান্স অপরচুনিটিজের উদ্যোগে, বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচটি উৎপাদক দেশের শ্রমিকদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ও সেগুলো প্রকাশ করা। আশা করা হচ্ছে, এ তথ্য-উপাত্ত বৈশ্বিক সরবরাহ ধারায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে।
Leave a Reply