দখিনের খবর ডেস্ক ॥ প্রযুক্তিই হবে অপরাধ দমনে বড় হাতিয়ার। ওই লক্ষ্যে দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেভাবেই সজ্জিত করা হচ্ছে। মাদক নির্মূল, দুর্নীতি দমন, জঙ্গী কার্যক্রম ঠেকানো, নির্যাতন বন্ধ করাসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের সেবার কাজে ব্যবহৃত হবে। মানুষের জন্য এটি হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন বছরে উপহার। কারণ প্রায় শতভাগ অপরাধের সঙ্গে আগে বা পরে প্রযুক্তির একটি যোগসূত্র থাকে। তাছাড়া আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীর কোন না কোন ক্লু বের করা সম্ভব হয়। বিশ্বের সকল উন্নত রাষ্ট্রে অপরাধ দমনে তথ্যপ্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত যেমন সহজ হয়, তেমনি অপরাধ সংঘটনে অপরাধীকে সতর্ক বার্তা দেয়া যায়। এ ধারণা সামনে রেখেই সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সজ্জিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সেবার কার্যক্রম তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। পুলিশ সদর দফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাদক নির্মূলকে নতুন বছরের অগ্রাধিকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে। মাদক নতুন প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় ৩শ’ বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে ওসব কেন্দ্র কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। যদিও ঢাকার অধিকাংশ মাদক নিরাময় কেন্দ্র বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসা পদ্ধতি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে না। প্রায়ই ওসব নিরাময় কেন্দ্রে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় এনে ওসব প্রতিষ্ঠান থেকে অপকর্ম দূর করা হবে। মাদককে বেশি প্রাধান্য দেয়ার অন্যতম কারণ প্রায় প্রতিটি অপরাধের সঙ্গে প্রযুক্তির পাশাপাশি মাদকেরও নিবিড় সম্পর্ক থাকে। তাছাড়া দ্রুত মাদক গ্রহণকারী শনাক্ত করতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। অপরাধীকে শনাক্ত করে সংশোধনাগারে পাঠানো গেলে মাদকের ব্যবহার কমবে। সূত্র জানায়, জঙ্গীবাদ দমন, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে তথ্যপ্রযুক্তি খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ কমানো হয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধী দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। দেশেও কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুন ও অপরাধের ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর অনুপাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমিত শক্তি দিয়ে সকল অপরাধ তৎপরতা দমন কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সব দিক বিবেচনায় পুলিশে প্রযুক্তির জন্য আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অপরাধীদের অন্যতম হাতিয়ার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওসব মাধ্যমের কর্তৃপক্ষ যথাযথ দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় দেয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ওসব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজবের সূত্র ধরে অনেক সময়ই দেশে বড় ধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক গুজব প্রতিরোধে একমাত্র সঠিক মনিটরিং আর গুজব সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতারই প্রধান ভরসা। অবশ্য এ ধরনের অপরাধ কমানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ রয়েছে। সীমিত পর্যায়ে হলেও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। সেজন্য দক্ষ জনবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার বাইরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, মাদক চোরাচালান, রাজনৈতিক অস্থিরতা গৃষ্টি, নাশকতা, ইভটিজিং, নারী-শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে গুজব পর্যন্ত প্রতিটি অপরাধ দমনে প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৫ সাল থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশে নিয়োগ পাওয়া সকল স্তরের সদস্যের প্রশিক্ষিত করা অব্যাহত রয়েছে। প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সাইবার বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয় পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন, অপরাধ উদ্ঘাটন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘের আওতায় পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। অপরাধ প্রতিরোধ, উদ্ঘাটন এবং নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশে নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রতিটি সদস্যকে সাইবার ক্রাইম বিষয়ে পারদর্শী করতে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ই-ট্রাফিকিং প্রসিকিউশন, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইমিগ্রেশন সার্ভিস, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নিয়োগ, টেন্ডার, কর্মকর্তাদের ই-মেইল ও ফোন নম্বর ইত্যাদি সুবিধা চালু করা হয়েছে। অনলাইন জিডি চালু করা হয়েছে। তাছাড়াও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে অপরাধীচক্র চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রযুক্তিগত পদ্ধতি চালু করেছে। সেজন্য রাজারবাগে আইসিটি (ইনস্টিটিউট অব সাইবার টেকনিক্যাল) প্রশিক্ষণ স্কুল খোলা হয়েছে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি প্রাধান্য দেয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার আফম আল কিবরিয়া জানান, সমাজে গতানুগতিক অপরাধ ছিল, আছে এবং থাকবে। বিশেষ করে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, ছিনতাই, ইভটিজিং থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধ রয়েছে। তার বাইরে রয়েছে প্রযুক্তিগত অপরাধ। যেসব অপরাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেশব্যাপী নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায় কোন কোন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। প্রতিটি অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রযুক্তির যোগসূত্র আছে। বিশেষ করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি গৃষ্টি করতে গুজব বা মিথ্যা প্রচার যেন কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। আইন-শৃৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স রয়েছে। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি অবস্থার উন্নতি হবে। একই প্রসঙ্গে পুলিশের এন্টি-টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক কামরুল আহসান জানান, জঙ্গীবাদকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সারাদেশে বিশাল নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে তা মনিটরিং করা হয়। অপারেশন চালানো হচ্ছে। প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন জেলা থেকে জঙ্গীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে জঙ্গীবাদ সম্পর্কে একটি সমৃদ্ধ তথ্য ভান্ডার থাকবে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে র্যাবের মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, র্যাব মূলত সব ধরনের অপরাধ নিয়েই কাজ করে। সমাজে হেন কোন অপরাধ নেই, যা নিয়ে র্যাব কাজ করে না। তবে দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে যে কোন ধরনের অপরাধ দমনে র্যা সব সময়ই বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। বিশেষ করে মাদক, জঙ্গী, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। কারণ এর সঙ্গে সমাজ ও মানুষের অনেক কিছুই জড়িত থাকে। তার বাইরে চুরি, ডাকাতি, সাইবার অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে র্যাব নতুন বছরে আরো গভীরভাবে কাজ করবে। একই প্রসঙ্গে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জানান, দেশে বা বিদেশে অপরাধের ধরণ পাল্টেছে। অপরাধের তদন্তকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে সিআইডি। তবে তার বাইরে সাইবার অপরাধ দমনকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। প্রযুক্তিগত অপরাধ দমনে প্রাথমিকভাবে একটি সাইবার থানা স্থাপনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে শুধু প্রযুক্তিগত অপরাধের তদন্ত হবে। প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা মামুলি ব্যাপারে পরিণত হবে। কারণ প্রায় সকল ধরনের অপরাধের আগে বা পিছে কোন না কোনভাবে প্রযুক্তির যোগসূত্র থাকে। নতুন বছরে অপরাধ নির্মূলের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, সব ধরনের অপরাধ দমনকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তবে এবার মাদক নির্মূলকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে মাদকের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মারাও গেছে। তারপরেও মাদকের আগ্রাসন থামানো যাচ্ছে না। মাদকসেবী বা ব্যবসায়ী কোনটিই কমছে না। অভিযানের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে।
Leave a Reply