দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দেশজুড়েই নদী দখলকারীরা বেপরোয়া। প্রতিটি জেলাতেই কমবেশি নদী দখল হয়েছে। অর্থাৎ দেশের ৬৪ জেলাতেই নদীর জমিতে ভূমিদস্যুদের থাবা রয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে হাউজিং সোসাইটি, মার্কেট, বসতভিটা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এমনকি চলমান উদ্ধার অভিযানের মধ্যেও বাড়ছে নদী দখলের মাত্রা। দীর্ঘ হচ্ছে দখলকারীদের তালিকাও। মূলত নদীর জমি দখলের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, নানা পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ তাদের পরিচিত বা নিকটাত্মীয়-স্বজনরা জড়িত। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করে নদীর জমি দখল নেয়া হচ্ছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। দখলের সঙ্গে কোন আপোস হবে না। তারই ধারাবাহিকতায় তালিকা ধরে ধরে চলছে উচ্ছেদ অভিযানও। তবে বিভিন্ন এলাকায় নদীর জমি উচ্ছেদের পর তদারকি না করায় ফের দখল হওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ওই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। আর বিগত ২০১৮ সালের হিসাবে দখলদারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নদী দখলদারদের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার। এখন তা বেড়ে প্রায় ৬৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি নদী দখলদার রয়েছে। সেখানে ১১ হাজার ২৪৫ জন নদী দখলদার রয়েছে। তার মধ্যে ৪ হাজার ৮৯০ জন অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর সিলেট বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা সবচেয়ে কম, ২ হাজার ৪৪ জন। ওই বিভাগে ২০১৯ সালে ৫৭৬ জনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ঢাকা বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯০ জন। আর উচ্ছেদ করা হয় নদীর জমিতে থাকা ১ হাজার ৪৫২ জনের ৫ হাজার ৯৩৫টি স্থাপনা। আর ঢাকা জেলায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, বালু, বংশী, গাজীখালী, কালীগঙ্গাসহ মোট ১১টি নদী ও ২০১টি খালের জমি বেদখল হয়েছে। ঢাকা জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫৮ জন। তার মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৯ জনের স্থাপনা। শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে ৯টি নদী ও ২১৮টি খাল রয়েছে। সেখানে নদী ও খাল দখলদারের সংখ্যা ৭৮৫ জন। ছোট-বড় সবকটি নদী ও খালই দখল হয়েছে। শিল্পায়নের নামেই বেশি দখল হয়েছে। শিল্পের নামে নদীর পাশে জায়গা কিনে স্থাপনা নির্মাণের সময় নদীর জায়গা দখল করা হয়েছে। আবার এমনও আছে সরাসরি নদীর জমি দখল করেই নির্মাণ করা হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। মানিকগঞ্জ জেলায় নদীর সংখ্যা ১৬টি আর খাল ১১৭টি; দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৩৯৯ জন। ফরিদপুর জেলায় ১৩টি নদী ও ১৫টি খাল রয়েছে; দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৪ জন। টাঙ্গাইল জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮ জন। ইতিমধ্যে ৬৪ জেলায় মোট ৫৭ হাজার ৩৯০ জন নদী দখলদারের ১৮ হাজার ৫৭৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা না থাকার কারণে জেলা প্রশাসনের পক্ষে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া করোনাভাইরাস মহামারীর কারণেও গত বছর উচ্ছেদ অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, বিগত কয়েক দশকে নানা কারণে নদীগুলো দখল হয়েছে। অথচ সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে নদীগুলো দখল মুক্ত করা সম্ভব। ওই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় আইন হয়েছে। আইন অনুযায়ী কেউ নদী দখল করলে এক থেকে ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। আর কেউ নদীর প্রবাহ বন্ধ করলে অন্য আইনেও শাস্তির বিধান রয়েছে। উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকেও নদী দখলকারীদের প্রয়োজনে শাস্তি বাড়ানোর আদেশ দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে দখলকারীদের থেকে ক্ষতিপূরণও আদায় করা যাবে। তাছাড়া কেউ যদি নদীর জমি ভরাট করে সেক্ষেত্রে মাটি ও বালু ব্যবস্থাপনা আইনে ২ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে। পানিতে বর্জ্য ফেলা হলে ১০ বছর পর্যন্ত দণ্ড দেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো একেবারেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। কিন্তু আইনে শাস্তির বিধান আছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অভিযান অব্যাহত রাখাও জরুরি। বর্তমানে দেশে নদী দখলের অভ্যাস স্থায়ী রূপ নিয়েছে। শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে দখলের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু সব নদী নাব্য ফিরে পেলে দখল কমবে। একইসঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে পানির ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নদীগুলোও প্রবাহ ফিরে পাবে। সূত্র আরো জানায়, আইন অনুযায়ী নদী অবৈধভাবে দখলকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো ভয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পেশি শক্তি ও রাজনৈতিক কারণে সাজা দিতে কর্মকর্তারা ভয় পায়। সেজন্য রাজনৈতিক সমর্থন জরুরি। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর জমি দখলমুক্ত করার পর তদারকি না থাকায় ফের দখল হচ্ছে। এভাবেই বেড়ে ওঠছে দখলদারের সংখ্যা। সেইসঙ্গে তালিকাভুক্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তাদের মতে, সরকারি জমি বা নদী দখলের অপরাধে আইনী ব্যবস্থায় দখলদারদের জেল জরিমানার যে বিধান রয়েছে বিভিন্ন আইনে তা নিশ্চিত করা গেলে দখলের মাত্রা কমে আসবে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও দখলদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। মূলত রাজনৈতিক সহযোগিতার অভাবেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় আইন প্রয়োগ কঠিন হয়ে যায়। সেজন্য রাজনৈতিক সমর্থন জরুরি। কারণ প্রতিবছরবা একদিকে নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান চলছে, অন্যদিকে বাড়ছে দখলদার। দখল উচ্ছেদ ও উচ্ছেদকৃত ভূমি যেন আবার দখলে না যায় এ দুটি কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, উচ্ছেদের পর ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। ফলে দ্রুতই উচ্ছেদকৃত ভূমি আবারও দখলে চলে যায়। তাতে একই কাজ বারবার করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আবারও টাকা খরচ করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হয়। অথচ নদীর জমি যদি দখলমুক্ত রাখা যায় তবেই দখলদারের তালিকা দীর্ঘ হবে না। সেইসঙ্গে নদী ফিরে পাবে তার নিজের জমি। ফিরবে নাব্য। নদী নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাও দ্রুত সময়ের মধ্যে সফল হবে। পাশাপাশি কমবে নদীদূষণের মাত্রাও। অন্যদিকে প্রতি বছর নদী দখলদারের সংখ্যা বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে নৌসড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জানান, নদী দখলের সঙ্গে যুক্তদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাবশালী। কেউ কেউ প্রশাসনিক প্রভাব নিয়েও নদীর জায়গা দখল করছে। সেজন্য দখল হওয়া স্থাপনা উচ্ছেদ করলেই হবে না, দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি। তাহলেই নদী দখল কমবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ে যারা নদীর জায়গা দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়াও প্রয়োজন।
Leave a Reply