দখিনের খবর ডেস্ক ॥ গ্যাস বিল বাবদ সারাদেশে গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। ওই বিপুল পরিমাণ বিল আদায়ে গ্রাহককে ক্রমাগত চাপ দেয়া হলেও বাস্তবে তা কোনো কাজে আসছে না। বরং কোনো কোনো কিভাবে বিল না দেয়া যায় সেজন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকির চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বকেয়া গ্যাস বিল আদায়ে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। ওই লক্ষ্যে জ¦ালানি বিভাগ থেকে ৩ মাসের বেশি বিল বকেয়া থাকলে নোটিস ছাড়াই গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত মাসের পর মাস বিল বকেয়া রাখার পরও নোটিশ দিয়েও বিল আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে ওই আদেশ কিছু এলাকায় বাস্তবায়ন শুরু করেছে। জ¦ালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে গ্রাহকদের কাছে গত নবেম্বর পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া ছিল। আর গত ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ১৯৪ কোটি টাকার মতো আদায় হয়েছে। এখনো ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো বকেয়া রয়েছে। দেশের সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে বকেয়া রয়েছে ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ১ হাজার ৯৭ কোটি আর বেসরকারি কোম্পানির কাছে বকেয়া রয়েছে এক হাজার ২৮১ কোটি টাকা। তাছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ক্যাপটিভ পাওয়ারের কাছে ১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বকেয়া রয়েছে এক হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। তার বাইরে সরকারি-বেসরকারি সার কারখানার কাছে ২২৭ কোটি, শিল্প কারখানার কাছে পৃথকভাবে আর এক হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়ার মধ্যে বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছে বেশিরভাগ এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি আবাসিকে বকেয়ার পরিমাণ ৪০৯ কোটি টাকা। সিএনজিতে ৩০৭ কোটি, চা বাগানের কাছে সাড়ে ৭ কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে। সূত্র জানায়, সাধারণত গ্যাস লাইন কাটার আগে কেন কাটা হচ্ছে সে সম্পর্কে গ্রাহককে নোটিশ দেয়া হয়। আর গ্রাহক চাইলে নোটিস পাওয়ার পর এক ধরনের আলোচনা শুরু করতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের সুবিধা বিবেচনায় বড় বিল কিস্তিতে দেয়ারও সুযোগ করে দেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো নানাভাবে তাগাদা দেয়ার পরও গ্রাহক বিল দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে শিল্প গ্রাহকদের কাছে সব থেকে বেশি বকেয়া বাড়ছে। বিল আদায় করতে গেলেই শিল্প গ্রাহকরা করোনার দোহায় দিচ্ছে। কিন্তু তারা শিল্প-কারখানা ঠিকই চালাচ্ছে। শিল্প কারখানা না চলানো হলে বিল আসার কথা নয়। যেহেতু শিল্প-কারখানাগুলো গ্যাস পোড়াচ্ছে, তাই তাদের সব ধরনের কাজ সচল রয়েছে। তারপরও তারা বিল দিতে টালবাহানা করছে। অথচ গ্যাস বিপণন নিয়মাবলিতে বলা হয়েছে কোন গ্রাহক যদি তিন মাসের বেশি বিল বকেয়া রাখে তাহলে লাইনটি নোটিস ছাড়াই কেটে দেয়া যাবে। সেক্ষেত্রে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। অতিসম্প্রতি জ¦ালানি বিভাগের সিদ্ধান্তে কার্যকর করার জন্য পত্র-পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রচারেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আবার পেট্রোবাংলাও দেশে গ্যাসের সঙ্কট থাকায় বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে। দেশে গ্যাসের বিল আদায় হোক বা না হোক নিয়মিত এলএনজির দাম পরিশোধ করতে হয়। তাতে পেট্রোবাংলাকে আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে দেশের সরকারি কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছে বিতরণ করে। গ্রাহক বিদ্যুতের বিল ঠিকমতো পরিশোধ না করলে বিতরণ কোম্পানিগুলো পিডিবির কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে পারে না। মূলত উৎপাদন-সরবরাহ ব্যবস্থার শেষ প্রান্তে রয়েছে গ্রাহক। গ্রাহক যদি সঠিক সময়ে বিল পরিশোধ না করে সেক্ষেত্রে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। আর ওই সঙ্কট সামাল দিতে না পারলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। সেক্ষেত্রে সরকারকে আর্থিক ঘাটতি মোকাবেলা করতে হয়। নয়তো উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে। যেহেতু উৎপাদন বন্ধ করলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে তাই সেটি করা সম্ভব নয়। ফলে বকেয়া বিল আদায়ের ব্যর্থতার কারণে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। করোনার মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন গতি ঠিক রাখার পাশাপাশি করোনা মোকাবেলাতে সরকার বিপুল অর্থের বিনিয়োগ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ এবং জ¦ালানির গ্রাহকরা দায়িত্বশীল আচরণ না করলে সঙ্কট সৃষ্টি হবে। যা মোকাবেলা করা কঠিন হবে। এদিকে পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাসের বিল আদায় না হওয়াতে পেট্রোবাংলা আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে। তিনি বলেন, বিল আদায় না হওয়াতে পেট্রোবাংলা আয় থেকে যে টাকা জমেছিল সেখান থেকে এলএনজির দাম পরিশোধ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। সঙ্গত কারণে বিল দেয়ার বিষয়ে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। অন্যদিকে চলতি ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হচ্ছে সেচ মৌসুম। এই সময়ে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। বর্ধিত বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকারকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হয়। কিন্তু দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে নতুন করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে হবে। কিন্তু এখন গ্যাস বিল আদায় না হলে এলএনজির মূল্য পরিশোধ সম্ভব হবে না। সেজন্য গ্যাস বিল আদায়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি চাপ দিচ্ছে জ¦ালানি বিভাগ। এ প্রসঙ্গে জ¦ালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মো. আবুল মনসুর জানান, বিপুল বিল বকেয়া পড়াতে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিল আদায়ের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো কিছু এলাকায় নোটিস ছাড়াই গ্যাস লাইন কেটে দেয়ার কাজ শুরু করেছে।
Leave a Reply