দখিনের খবর ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার পাটের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারপরও দিন দিন বেড়েই চলেছে পাটের দাম। এমনকি পাটের দাম নিত্যপণ্যকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান দরে এক কেজি পাটের দাম আড়াই কেজি চালের সমান। প্রতি কেজি পাট বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা আর প্রতি মণ ৫ হাজার ২০০ টাকা। এই দর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবু মিলছে না পাট। আর এতো চড়া দামে পাট কিনে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে পাটকল। ইতিমধ্যে শতাধিক বেসরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও বন্ধের উপক্রম। আর গত বছর মার্চেই সরকারি সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের পাটশিল্পের অর্থনীতিতে নতুন বিপর্যয় নেমে আসবে। কারণ পাট ঘিরে চাষিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেশের ৪ কোটি মানুষের জীবিকা চলছে। পাট অধিদফতর এবং বিজেএমএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পাটের চড়া দামে দেশের শতাধিক পাটকল বন্ধের পাশাপাশি দেড়শ কল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।আর চালু থাকা মিলগুলো খুব বেশি দিন চালু রাখা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) পাটকলের সংখ্যা ছিল ২৯৬টি। ওসব মিলে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ। তার মধ্যে এক লাখ শ্রমিকই এখন বেকার। পাটকল মালিকদের মতে, মূলত কারসাজি ও মজুদদারির কারণে দেশে পাটের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এবার মৌসুমের শুরুতে অধিক পরিমাণে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে। পরে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে অনেকে পাট মজুদ করে রেখেছে। তাই বাজারে জোগান কম। ফলে দাম বাড়ছে। সূত্র জানায়, দেশে এ বছর ৭২ লাখ ৮৬ হাজার বেল পাট উৎপাদন হয়েছে। আগের বছর তা ছিল ৭৪ লাখ বেল। আর এ বছর রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ বেল। আর পাটকলগুলোতে ব্যবহার হয়েছে ৩০ লাখ বেল। গৃহস্থালিতে ব্যবহার হয় প্রায় ৫ লাখ বেল। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ও কিছু পাটকল মালিকের হাতে এখন মাত্র ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৮২৫ বেল রয়েছে। এ পর্যন্ত পাটের মোট ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৮২৫ বেল। মোট উৎপাদন থেকে তা বাদ দিলে দেশে এখনো প্রায় ২৩ লাখ বেল কাঁচাপাট থাকার কথা। কিন্তু বাজারে পাট নেই। কিন্তু বৈধ ও অবৈধ মজুদে আটকা পড়ে আছে পাট। মৌসুমের শুরুতে গত জুলাই মাসে এবার কাঁচা পাটের রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি হয়েছে। জুলাই-আগস্টে রপ্তানি বেশি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। অবশ্য পরে তা কমতে থাকে। মূলত প্রথমদিকে অস্বাভাবিক রপ্তানির কারণেই দেশে পাটের সংকট শুরু হয়। তার সঙ্গে মজুদদারি যুক্ত হয়ে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। তারপর বাংলাদেশে পাটের মূল্য বেশি হওয়ায় রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মৌসুমের শুরুতে পাটের দর ছিল ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ। সাধারণত ওই সময় পাটকল মালিকরা বছরের মোট চাহিদার একটা বড় অংশ হাট থেকে সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু এ বছর মৌসুম শুরু হওয়ার ঠিক আগে মার্চে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পাটের দাম পড়ে যাবে এমন ভাবনায় বেসরকারি পাটকলগুলো এ বছর হাট থেকে অনেক কম পাট সংগ্রহ করেছে। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে পাটপণ্যের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের পাটপণ্য। ইতিমধ্যে অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছে। এমন অবস্থায় কোনো কোনো উদ্যোক্তা ক্রেতা ধরে রাখতে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে পাটপণ্য বিক্রি করছে। এক টন পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয় এখন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আর তা রপ্তানি হচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার টাকায়। উদ্যোক্তাদের ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। দেশে ৩ শতাধিক বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন, বিক্রি ও রপ্তানি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ভারত পাটের উল্লেখযোগ্য বাজার। তবে পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি পাটপণ্য রপ্তানি হয়। পাটের এ সংকট কাটাতে উদ্যোক্তারা তাই আমদানির অনুমতি চাচ্ছে। সেজন্য উদ্যোক্তারা দেশে পাট আমদানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চায়। কারণ এবার ভারতে বিপুল পরিমাণ কাঁচা পাট রপ্তানি ও পাচার হয়েছে। এখন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দরে ভারত থেকে পাট আমদানি করা সম্ভব। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিজেদের রপ্তানি করা পাটই বেশি দামে আবার আমদানি করতে হবে। এদিকে পাট সঙ্কটের বিষয়ে উদ্যোক্তারা সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে প্রথমে চিঠি এবং পরে বিজেএমএ-বিজেএসএ নেতারা দেখা করেছেন। মন্ত্রীকে দেয়া দুই সংগঠনের চিঠিতে বলা হয়, অতি মুনাফালোভীরা কাঁচা পাট মজুদ করে দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। পাট সংকটের কারণে আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে ৯৫ শতাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া চিঠিতে বৈধ লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরাও যাতে ৫০০ মণের বেশি পাট এক মাসের বেশি সময় মজুদ রাখতে না পারে, তা আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জমের মতে, কাঁচা পাটের মজুদ পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে তদারক করা দরকার। দর বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয়। বাজারে আরো বেশি পাটের মজুদ থাকার কথা। সেজন্য সবার আগে পাট ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মজুদ রোধে মনিটরিং জোরদার করা জরুরি। তাছাড়া বিদ্যমান অবস্থায় পাট আমদানি করা যেতে পারে। সরকার শিল্পে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান অর্থাৎ অর্থনীতির স্বার্থে সীমিত সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচা পাট আমদানির অনুমতি দেয়ার চিন্তা করতে পারে। তবে খুব সতর্কতার সঙ্গে চাহিদা ও জোগান পর্যবেক্ষণ করেই আমদানির অনুমতি দিতে হবে। এ বিষয়ে বিজেএমএ সভাপতি মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী জানান, কৃষকের হাতে নেই এখন পাট নেই। যা আছে তা ব্যবসায়ী বা মজুদদারদের হাতে রয়েছে। তাদের কাছ থেকে এখন মণপ্রতি ৫ হাজার ২০০ টাকায় পাট কিনছে উদ্যোক্তারা। দেশের ইতিহাসে কখনো পাটের এতো বেশি মূল্য ছিল না। আর এ দামে পাট কিনে শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হোসেন আলী খোন্দকার জানান, উদ্যোক্তারা ঠিকই বলছে। আসলেই কাঁচা পাটের সংকট চলছে। তবে সরকার তৎপর। অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বাজারে পাটের সরবরাহ বাড়ানো গেলে সংকট নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
Leave a Reply