দখিনের খবর ডেস্ক ॥ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেনাকাটায় উপেক্ষিত দেশীয় তৈরি মানসম্পন্ন রফতানিযোগ্য পণ্য। ফলে দেশীয় পণ্যের বিকাশ সাধন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ প্রযুক্তির এ যুগে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে তৈরি পণ্য এখন রফতানি হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। আমদানি বিকল্প পণ্য তৈরি করায় সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। যা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে সুসংহত করছে। কিন্তু খোদ সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই রফতানিযোগ্য মানসম্মত ওসব পণ্য কিনছে না। বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এমন শর্তারোপ করছে যাতে দেশীয় কোম্পানিগুলো সরকারি কেনাকাটায় অংশ নিতে না পারে। ফলে সরকারের শিল্পনীতিতে ‘আমদানি বিকল্প স্থানীয় শিল্প’-এর কথা বলা হলেও সরকারের কিছু সংস্থার নিজস্ব সিদ্ধান্তের কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকার নানাভাবে শিল্পোদ্যোগ গড়ে তোলা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের কৌশলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অত্যাধুনিক মেশিনারি সম্বলিত আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাক্টরিসমূহে এখন এদেশেই এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর-ফ্রিজার, কম্প্রেসার, টেলিভিশন, প্যাসেঞ্জার লিফট, কার্গো লিফ্ট, ইলেকট্রিক্যাল সুইচ-সকেট, ফ্যান, এলইডি লাইট-বাল্ব, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ-ডেস্কটপ কম্পিউটার ও ইলেকট্রিক্যাল হোম এবং কিচেন এ্যাপ্লায়েন্সসহ নানা কিছু উৎপাদিত হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং দামেও সাশ্রয়ী। উল্লেখিত পণ্যসমূহ উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর-ফ্রিজার, কম্প্রেসার, কম্প্রেসার পার্টস ও টেলিভিশন দেশের গণ্ডি পার হয়ে জার্মানী, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, স্লোভাক রিপাবলিক, গ্রীস, স্লোভেনিয়া, তুরস্ক, ভারত, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, সুদান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, ইস্ট তিমুর, মালদ্বীপ, সিসিলি ও মালাওয়িসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে খ্যাতনামা ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ড কেলভিনেটর, কোরিয়ান ব্র্যান্ড হুন্দাইসহ অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠান ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডে এখন দেশীয় ফ্যাক্টরি হতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য তৈরি করে নিচ্ছে। তাতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সাশ্রয় করার পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, পূর্ত অধিদফতরের বিদ্যমান সিডিউল অব রেটস (এসওআর) অনুযায়ী অধিকাংশ দরপত্রে দেশীয় ব্র্যান্ড বা দেশীয় উৎপাদনকারীর অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যদিয়ে দেশীয় ব্র্যান্ড বা উৎপাদনকারীরা তালিকাভুক্ত হতে সক্ষম হলেও কার্যত তারা দরপত্রের মাধ্যমে সরকারী কেনাকাটার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে। একটি দরপত্রে সাব হেড-৭, স্পিøট টাইপ এয়ার কুলার-এর নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কিছু দেশের নামোল্লেখের মাধ্যমে তাদের ৭ এর ২এ তালিকায় সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি একই স্পেসিফিকেশন বা নির্দিষ্টকরণ বা সবিস্তার বিবরণী বা কারিগরি বিনির্দেশ অনুযায়ী অন্যকিছু দেশের নামের সঙ্গে বাংলাদেশে উৎপাদিত মানসম্মত এয়ারকুলারকে ৭এর ২বি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমদানিকৃত ৭ এর ২এ তালিকাভুক্ত বিদেশী ব্র্যান্ডের দাম বেশি। দেশে উৎপাদিত সমমানের ৭এর ২বি তালিকাভুক্ত দেশীয় ব্র্যান্ডের দাম কম ধরে এসওআর-এ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে বেশি দামের বিদেশী ব্র্যান্ড মানেই এ গ্রেডের পণ্য এবং একই মানের কম দামের দেশী ব্র্যান্ডের পণ্য বি গ্রেড বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারি তহবিলে যেহেতু টাকার কোন ঘাটতি নেই, তাই অধিকাংশই বেশি দামের বিদেশী ব্র্যান্ড বা দেশের স্বার্থে পিপিআর-২০০৮ এর ধারা ২৯(৩) লঙ্ঘন করছে। তাছাড়া পিডব্লিউডির সিডিউল অব রেটসকে (এসওআর) সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আর উক্ত সিডিউল অব রেটসে মানসম্মত দেশীয় ব্র্যান্ড বা দেশীয় পণ্যকে বি তালিকাভুক্তসহ দামের বৈষম্য করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে রেখেছে। সূত্র আরো জানায়, এসওআর-এ অন্য দেশের নাম বা ব্র্যান্ড উল্লেখ থাকায় প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি দরপত্রে বেশি দামের আমদানিকৃত পণ্যের ব্র্যান্ড বা দেশের নাম সরাসরি উল্লেখ থাকে। ফলে দেশীয় ব্র্যান্ড বা উৎপাদনকারীরা কম মূল্য প্রস্তাব করে দরপত্রে সমমানের (ইক্যুয়াভেলেন্ট) বদৌলতে অংশ নিলেও কৌশলে বাদ পড়ে যায়। ফলে সুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশীয় উৎপাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বিদ্যমান পিপিআর ২০০৮এর বিধি ২৯(৩) এর সরাসরি ব্যত্যয় ঘটছে। যেখানে বলা হয়েছে ‘কারিগরি বিনির্দেশে কোন পণ্যের ট্রেডমার্ক বা পণ্যের ব্যবসায়িক নাম পেটেন্ট, নক্সা বা ধরন, নির্দিষ্ট উৎস দেশের না (কান্ট্রি অব অরিজিন), উৎপাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না।’ এবং উপ-বিধি (৪)-এ নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্যের বিবরণ উল্লেখ করার সুযোগ থাকলেও ব্র্যান্ড ও কোন দেশের নাম উল্লেখ করার সুযোগ নাই। সেক্ষেত্রে পূর্ত অধিদফতরের সিডিউল অব রেটস-এ অন্য দেশের নাম বা ব্র্যান্ড উল্লেখ থাকা দুঃখজনক। যা দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে অপব্যবহার করে বিদ্যমান পিপিআর সংশ্লিষ্ট বিধির সরাসরি ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে সার্বিক পূর্ত অধিদফতরের সিডিউল অব রেটস-এ বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও দেশের নাম বাদ দিয়ে, দেশীয় মান বজায় রেখে তালিকাভুক্ত দেশী-বিদেশী সকল ব্র্যান্ডকে সুনির্দিষ্ট একই স্পেসিফিকেশনের আওতায় সমমূল্যের এক সাবহেডে রাখা যৌক্তিক।
Leave a Reply