মির্জাগঞ্জের মাধবখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ‘জমিদারি’
দখিনের খবর ডেস্ক ॥ জমিদারি নেই, বিলুপ্ত জমিদার। আধুনিকতার এই যুগে তবু সচল ‘খাজনা’। চেয়ারম্যানকে খাজনা দিলেই সরকারি সেবা মেলে। খাজনা নিয়ে টালবাহানা কিংবা প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। প্রতিবাদ করলে নির্মমতা কী পর্যায়ের হয় সেটার জানান দিতে নির্যাতন চলে প্রকাশ্যে। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের মাধবখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম তালুকদার এখনো জারি রেখেছেন এই খাজনাপ্রথা। চেয়ারম্যানের খাজনাকাণ্ডে অতিষ্ঠ ইউনিয়নের সাধারণ মানুষসহ অন্য ইউপি সদস্যরা। এই অন্যায়ের সমাধান খুঁজতে ইউনিয়ন পরিষদের অন্য সদস্যরা পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৬ সালে মনিরুল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩২৫টি ভিজিডির নাম আসে। প্রতি নামে চেয়ারম্যান দুই হাজার টাকা করে ‘খাজনা’ দাবি করেন। পরে দুই হাজার টাকা করে ‘খাজনা’ দিয়েই ভিজিডি সুবিধা নেন ৩২৫ ব্যক্তি। এলজিএসপি প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে গভীর নলকূপ বসিয়ে তাতেও হাজার হাজার টাকা খাজনা আদায় করা হয়। কখনো আবার ওই প্রকল্পের টাকায় কেনা নলকূপ না বসিয়ে পুরো টাকাই চেয়ারম্যান মনিরুল পকেটে পুরেন। স্থানীয়রা জানায়, প্রতিটি নলকূপ বসাতে চেয়ারম্যান ‘খাজনা’ নেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। চেয়ারম্যান মনিরুল নলকূপ বসিয়ে হাজার হাজার টাকা নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন ঝাটিবুনিয়া গ্রামের আসমত আলী হাওলাদার, মো. লিটন হাওলাদার, লেবুবুনিয়া গ্রামের মো. আদল মল্লিক ও আব্দুল মান্নান মল্লিক এবং মাধবখালী গ্রামের আব্দুল রাজ্জাক মৃধা। এ ছাড়া নলকূপের ভিটি (প্ল্যাটফর্ম) তৈরি করতে ছয় হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও চেয়ারম্যান ভিটি তৈরি না করে ওই টাকাও হাতিয়ে নেন। ইউপি সদস্য জামাল অভিযোগ করেন তাঁর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এজিএসপির অর্থায়নে পাঁচটি নলকূপ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। দুটি স্থাপন না করে পুরো টাকাই ইউপি সদস্য জামালের সই জাল করে চেয়ারম্যান মনিরুল আত্মসাৎ করেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দুস্থদের জন্য বরাদ্দ করা খুঁটির ঘর এবং পাকা ঘর পেতেও চেয়ারম্যান মনিরুলকে খাজনা দিতে হয়। খুঁটির ঘরে ২০ হাজার এবং পাকা ঘরের জন্য ‘খাজনা’ নেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজিতা গ্রামের এক দুস্থ বলেন, ‘১৫ আজার (হাজার) টাহা লোন লইয়া মিলাইয়া ঝিলাইয়া চেয়ারম্যানরে দিছি। টাহা না দেলে তো ঘরটা পাইতাম না। কষ্ট অইলেও লোন কইরগা ঘরডা পাইছি এইডাই শান্তি।’ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর ঝাটিবুনিয়া গ্রামের দুস্থ দেলোয়ার হোসেনের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি এক বান টিন ও ছয় হাজার টাকা বরাদ্দ পান দেলোয়ার। ওই টিন এবং টাকা দেলোয়ারকে না দিয়ে চেয়ারম্যান মনিরুল নিজেই নিয়ে নেন। এলজিএসপি প্রকল্প থেকে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের জন্য প্রতিটি সৌরপ্লান্ট থেকে তিন হাজার টাকা ‘খাজনা’ আদায় করেন তিনি। এ ছাড়া ওই প্রকল্পের বেশ কয়েকটি সৌরপ্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে তাঁর নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য নাম অন্তর্ভুক্ত করতে প্রথমে তিন হাজার এবং ভাতা হাতে পাওয়ার পর দুই হাজার পাঁচ শ টাকা খাজনা দিতে হয় চেয়ারম্যান মনিরুলকে। ৪০ দিনের সব প্রকল্পেও ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করায় পাঁচ ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আকন, আমিনুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, লিয়ন হাওলাদার ও জামাল হাওলাদারকে ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পিটিয়ে আহত করে মনিরুল ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। এসব অনিয়মে অসহ্য হয়ে ইউপি সদস্য মো. জামাল হোসেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক এবং দুদকের উপপরিচালকের কাছে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগকারী ইউপি সদস্য মো. জামাল হাওলাদার বলেন, ‘নিজেকে এলাকার জমিদার মনে করেন তিনি। যা মন চায় তাই করেন। কোনো নিয়মই মানেন না। চেয়ারম্যানকে খাজনা দিয়ে এলাকার মানুষকে সরকারি সুবিধা নিতে হয়। আমি যে ওয়াদা দিয়ে মেম্বার হয়েছি তা পালন করতে পারি না চেয়ারম্যানের কারণে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের অন্যায় কাজের বিচার চাই।’ ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আকন বলেন, ‘চেয়ারম্যান মনির তালুকদার পুরো মাধবখালী ইউনিয়নকে নিজের জমিদারি এস্টেট মনে করেন। জমিদারি প্রথার মতোই চলছে তাঁর কার্যক্রম। অনিয়ম ছাড়া সরকারের কোনো নিয়ম নেই এখানে। আমিও তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করব।’ এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
Leave a Reply