বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশালে বালুর অবৈধ উত্তোলন থামানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। বিষয়টি গুরত্ব সহকারে একাধিকবার প্রকাশিত হলেও কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি কতৃপক্ষ। এ বিষয়ে সচেতন মহলসহ সাধারন মানুষেরও মনে ক্ষোভ দেখা যায়। এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে থলের বেড়াল। বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের নেতা ও কথিত মুক্তিযোদ্ধা আনিস মীরার ছেলে সৈয়দ আবেদ এর নের্তৃত্বে চুরি হচ্ছে সরকারি খনিজ সম্পদ। নগরীর তালতলি, শায়েস্তাবাদ, চরমোনাই, চরআবদানিসহ বিভিন্ন এলাকায় খোলামেলা ভাবেই চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন।
স্থানীয়দের এক ব্যবসায়ী বলেন, দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই চলে এ বালুর ড্রেজার। এতে যেমন চুরি হচ্ছে রাষ্ট্রের খনিজ সম্পদ, অপরদিকে নদী পাড়েরর রাস্তা, নদীগর্ভে বীলিন হচ্ছে বসতবাড়ি। বরিশালের নদীগর্ভ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলণকারী হানিফ, বাচ্চু, মিজানের চারটি অবৈধ ড্রেজার নিয়মিত চলছে নদীর বালু উত্তোলন কাজে। ভ্রাম্যমাণ এ চারটি ড্রেজারের বালু উত্তলনের ফলে চরকাউয়া, চরমোনাই, চরআবদানি, শায়েস্তাবাদসহ আরও নদী সংলগ্ন এলাকাগুলো ভেঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে বহু আগেই। বেশীরভাগ ফসলি জমি ইতিমধ্যে চলে গেছে নদীর জলে। বদলে যাচ্ছে নদীর গতীপথ। ছোট হয়ে আসছে বরিশালের মানচিত্র। পাশাপাশি আশপাশের পাকা রাস্তা, অসংখ্য বসত বাড়ির দালানে দেখা দিয়েছে ফাটল। সরজমিনে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
জানা গেছে অবৈধ বালুর ব্যবসার সাথে জরিত স্থানীয় কাউনিয়া ও কোতওয়ালি মডেল থানার অসাধু কতিয় কর্মকর্তা। যারা অভিযানের খবর সরবরাহ করে মাসিক “বিট মানি” নিয়ে থাকে। আবার কোষ্টগার্ড ও নৌপুলিশ এর অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছেএই অবৈধ বালু উত্তোলন কাজে। আরও জানা গেছে এসিল্যান্ড, ডিসি অফিসের সাথেও লক্ষাধিক টাকা লেনদেন করে টিকে আছে এ অবৈধ সিন্ডিকেট। অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের মূল হোতা হানিফ, বাচ্চু, মিজান। এ তিনজন সিন্ডিকেটের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। হানিফ টাকা পয়সার লেনদেন ও ক্যাডারদের লালন পালন এর কাজ করে। বাচ্চু ও মিজান সংশ্লিস্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে চুক্তি করে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাত এগারটার পর থেকে চারটি মেশিন ভোররাত পাঁচটা পর্যন্ত বালু উত্তোলন করে। সুযোগ পেলে দিনেও চালায়। কোন ধরনের মাপ, হিসাব ছাড়াই প্রতিদিন শত শত ঘনফুট বালু নিয়ে যাচ্ছে হানিফ গ্রুপ। রাষ্ট্রের এমন দামি খনিজ সম্পদ চোঁখের সামনেই ছিনতাই করছে হানিফের মত অবৈধ ব্যবসায়ীরা। এর ফলে একদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, আবার প্রাকৃতিক ভারসম্য হচ্ছে নষ্ট।
এ বিষয়ে হানিফ, বাচ্চু, মিজান বলেন, ‘আমাদের বৈধতা নেই। আমরা এসিল্যান্ড, নৌ-পুলিশ, কাউনিয়া থানা, কোতয়ালি থানা ও ডিসি অফিসে টাকা দিয়েই এ কাজ করি। আমাদের ইজারা বন্ধ থাকায় আমরা অবৈধভাবে বালু তুলি। আপনারা লিখবেন, আমাদের ধরবে। মেরিন কোর্টে, এসিল্যান্ডে টাকা দিয়ে আবার ছাড়িয়ে আনবো। এ সময় হানিফ বরিশাল ছাত্রলীগের নেতা আবিদকে ফোন দিয়ে এর দায় নিতে বলে এবং মূল মালিক হওয়ার কারনে তাকেই সাংবাদিকদের মোকাবেলা করতে বলেন।
মেহেন্দিগঞ্জের বৈধ ইজারাদারদের পক্ষ থেকে কোতওয়ালি মডেল থানায় একটি চাঁদাবাজি সংক্রান্ত লিখিত অভিযোগ করে গত ১০ ই অক্টোবর ২০১৭ তে। সেখানে বলা হয়, হানিফ, বাচ্চু, মিজান গং প্রতি বালুর ট্রলারে এক হাজার টাকা চাঁদা দাবীকরে। তারা আরও বলেন, আমরা সরকারের বৈধ ইজারাদার। আমরা মেহেন্দিগঞ্জের বালু আনতে গেলেই দিতে হয় নৌকা প্রতি ১ হাজার টাকা। ২০ পয়সা করে এক ফুট বালুতে। ওদিকে তালতলি ব্রিজের পশ্চিম দিকে প্রায় ৪০ হাজার ঘনফুট বালু কেটে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাল টাকা। প্রতি ঘনফুট বালু বিক্রি করছে ৯-১০ টাকা। বাচ্চুর ড্রেজার কাউনিয়া থানায় পয়সা দিয়ে রাতে তালতলি থেকে বালু উত্তোলন করে। বিএনপি’র বিপ্লব এর মাধ্যমে এ কাজগুলো হয়। আর প্রশাসন ম্যানেজে নেমেছে সাগরদী’র যুবলীগ নেতা হেমায়েত। সংবাদ প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইজবুকে বিষয়টি নিয়ে প্রচন্ড বিতর্কের সৃষ্টি হয় কতৃপক্ষের গাফলতি নিয়ে। সেখানে মন্তব্য করে প্রশ্নের উত্তর দেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন। বরিশালের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইজবুকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ” রাতে ১০ টার পর বালু উত্তলন করলে আমি কিভাবে ধরব? আমি এতে লজিস্টিক সাপোর্ট পাইনা। ‘কোষ্টগার্ড ও নৌ-পুলিশকে নির্দেশনা দেবেন কি না, আর বালুখাদক হানিফ গং আপনাদের সাহায্য পায় কথাটা কতটুকু সত্য? সেই প্রশ্নে তিনি কোন উত্তর দেননি। ‘কোষ্টগার্ড এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, “আমাদের নিয়মিত তথ্য দিলে আমরা তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনবো। ‘সর্বশেষ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বরিশালের জেলা প্রশাসক, এডিসি (রাজস্ব), সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে লিখিতভাবে অবগতি করেছেন এ প্রতিবেদক। তবে এখনও কোন কার্যকরি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অথচ ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগান ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। বালু উত্তোলনের ফলে ওই এলাকার আশপাশের অনেক কৃষকের আবাদি জমি ভেঙে গেছে।
Leave a Reply