নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ যেকোন নির্বাচন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। নির্বাচনে যে প্রার্থী বিজয়ী কিংবা পরাজিত হোকনা কেন, হামলার শিকার হতে হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের। নির্বাচনের পর বাড়ি-ঘরে আগুন জ¦ালিয়ে দেয়া কিংবা নারীদের ওপর পার্শ্ববিক নির্যাতনের ঘটনাও নতুন কোন ঘটনা নয়। তাই আসন্ন ইউপি নির্বাচনকে ঘিরেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সংখ্যালঘু ভোটারদের মাঝে। এনিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথমধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীরা প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন। ফলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা লেগেই রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে অন্য উপজেলার ভাড়াটিয়া লোকজন এসে নির্বাচনী এলাকার সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু ভোটারদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। এমনকি প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ভোটারদের গণধর্ষণের হুমকি দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতারা অভিযোগ করেন, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে ভুল সিদ্ধান্ত ও বির্তকিতদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের দুর্দীনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতারা বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন। এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগসহ বেশিরভাগ ভোটাররা। ফলে নৌকা পেলেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মনোভাবের প্রার্থীরা অন্য উপজেলার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের ওপর নির্ভর হয়ে পরেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সাতলা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই ইউনিয়নের সংখ্যালঘুু ভোটারদের নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে নৌকা মার্কার প্রার্থীর সমর্থকরা। ইতোমধ্যে বহিরাগতদের নিয়ে সন্ধ্যার পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নৌকায় ভোট না দিলে পুরুষ ভোটারদের কুপিয়ে হত্যা এবং নারী ভোটারদের গণধর্ষনের হুমকি দেয়া হয়েছে। ফলে নির্বাচনের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের মাঝে। বিষয়টি জেলা পুলিশ সুপারকে অবহিত করার পর তিনি বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সূত্রমতে, সাতলা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য শাহিন মাহামুদ হাওলাদারকে। বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল বাশার লিটন দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়াও ওই ইউনিয়নে খোকন বিশ্বাস ও আবু তাজিন মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও ভোটের হিসেবে বর্তমান চেয়ারম্যান লিটন আনারস প্রতীক নিয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর চেয়ে অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন। সরেজমিনে সাতলা ইউনিয়নের পটিবাড়ি গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, ওই ইউনিয়নের সাবেক প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুল খালেক আজাদের ছোট পুত্র মনির মিয়া গত কয়েকদিন থেকে অপরিচিত লোকজন নিয়ে নৌকা মার্কার সমর্থনে গণসংযোগের নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক পটিবাড়ি গ্রামের বল্লভ বাড়ির একাধিক নারী-পুরুষরা অভিযোগ করেন, মনির মিয়া ও তার সাথে থাকা অপরিচিত (ভাড়াটিয়া) ব্যক্তিরা হুমকি দিয়ে বলেছেন নৌকার বাহিরে ভোট দিলে পুরুষ ভোটারদের কুপিয়ে হত্যা ও নারীদের গণধর্ষণ করা হবে। এ সময় ঘটনাস্থলে থাকা আবদুল মাজেদ সরদার ও অমল বল্লভ নামের স্থানীয় দুই ব্যক্তি মনির ও তার সহযোগিদের হুমকির প্রতিবাদ করলে তাদের অন্ডকোষ ধরে ঘুড়ানো হবে বলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই এলাকার ভোটারদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সূত্রমতে, হুমকিদাতা মনির মিয়ার বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে অসংখ্যবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও নির্যাতনের বিস্তার অভিযোগ রয়েছে। অতিসম্প্রতি ডাঃ মনোরঞ্জন বৈদ্য নামের এক এমবিবিএস চিকিৎসককে হত্যার হুমকি দেয় মনির। এ ঘটনায় উজিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়েছে। এছাড়াও তাপস ফলিয়া নামের এক ব্যক্তিকে বাড়িতে ঢুকে বেধরক মারধর করেছিলো মনির ও তার সহযোগিরা। ইউনিয়নবাসী প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নির্বাচনের আগেই বহিরাগত মুক্ত করে সুষ্ঠ নির্বাচনের দাবি করেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের হুমকির অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী খায়রুল বাশার লিটন বলেন, যাদের (সংখ্যালঘু) একচেটিয়া ভোটের কারণে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠণ করে, সেই ভোটারদের হত্যা ও গণধর্ষণের হুমকি দেয়া কোন আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সমর্থকদের কাজ হতে পারেনা। এসব হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে এখনই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে এর প্রভাব পরবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। বিষয়টি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। ভোটের ফলাফলে আমি যাই হইনা কেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ কোন ভোটারদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা কিংবা অন্যান্য হুমকি দিয়ে কেউ রেহাই পাবেনা। অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী শাহীন মাহামুদ বলেন, আমার কোন সমর্থক এ ধরনের হুমকি দেয়নি। তিনি আরও বলেন, প্রতিপক্ষের লোকজনে নৌকার জোয়ার দেখে নানা অপপ্রচার শুরু করেছেন। অপরদিকে গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী সুভাষ হালদার অভিযোগ করেন, প্রতিদ্বন্ধী নৌকা মার্কার প্রার্থী ফারুক মোল্লা তার পরাজয় নিশ্চিত জেনে ভাড়াটিয়া লোকজন নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর (আগরপুর) ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী অধ্যাপক কামরুল ইসলাম হিমু অভিযোগ করেন, তার জনপ্রিয়তায় ঈশ্বানিত হয়ে কর্মী-সমর্থক বিহীন নৌকার প্রার্থী সরদার তারেকুল ইসলাম তারেক ও তার সমর্থক এককালের দুর্ধর্ষ সর্বহারা ক্যাডাররা ইউনিয়নের সংখ্যালঘু ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ওই সর্বহারা নেতারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইউনিয়ন যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে আমাকে (হিমু) ফাঁসাতে চেয়েছিলো। তাদের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় গত দশদিন থেকে ওই যুবলীগ নেতা নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন। এদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনী উঠান বৈঠকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা এক ইউপি সদস্যকে ভোট প্রদান না করলে নির্বাচনের পর তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি প্রদান করায় সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঘটনাটি গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের। ওই ওয়ার্ডের বছার ও পশ্চিম চন্দ্রহার গ্রামের একাধিক সংখ্যালঘু ভোটাররা জানান, গত কয়েকদিন পূর্বে পশ্চিম চন্দ্রহার গ্রামের একটি সভায় মেম্বার প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন বেপারীকে সংখ্যালঘুদের শতভাগ ভোট দেয়ার জন্য হুমকি প্রদান করা হয়। এ বক্তব্যের পরপরই ওই এলাকার সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মেম্বার প্রার্থী হোসেন বেপারী স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সদস্য। তার (হোসেন) আপন বড় ভাই আক্কাস বেপারী একজন স্বীকৃত রাজাকার ছিলেন। এ ছাড়া হোসেন বেপারীকে বেশ কিছুদিন পূর্বে জুয়ার আসর থেকে গ্রেফতার করেছিলো আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোন ধরনের হুমকি প্রদর্শন ও সহিংসতা বন্ধে উপজেলা পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, নির্বাচনের পূর্বেই বহিরাগতদের ইউনিয়ন থেকে বের করে দেয়ার জন্য স্ব-স্ব থানার ওসিদের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে ও পরবর্তী সময়ে যেকোন ধরনের সহিংসতারোধে পুলিশের একাধিক টিম ইতোমধ্যে মাঠে কাজ শুরু করেছেন। ফলে কোন ভোটারদেরকেই আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।
Leave a Reply