স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশের ন্যায় বরিশালও করোনা ঊর্ধ্বমুখী, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। করোনা ভাইরাস সংক্রামণরোধে সরকারের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হলেও বরিশালের গণপরিবহনে নির্দেশনা মানা হচ্ছেনা। যাত্রীদের কাছ থেকে আগের চেয়ে ভাড়া ৬০% বৃদ্ধি করে আদায় করা হলেও গণপরিবহনগুলোতে আগের মতোই যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। এতে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন বরিশালবাসী। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, খুব শীঘ্রই ডাবল সিটে একজন যাত্রী পরিবহন করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ ঘন্টায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের আরটি পিসিআর ল্যাবে ১৮১ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৭ জনের। শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ। এরআগের ২৪ ঘন্টায় ১৮১ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে ৩৭ জনের। শনাক্তের হার ১৮ শতাংশ। এরআগে গত ৩১ মার্চ শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া ৯৩ জনের মধ্যে ২৫ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এরআগের দিন ৩০ মার্চ ভর্তি হওয়া ৮৭ জনের মধ্যে ২৫ জন ও ২৯ মার্চ ৫৪ জনের মধ্যে ২২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় গণপরিবহনের এক সিট ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। নির্দেশনা দিয়েছে ভাড়া বাড়ানোর। কিন্তু বরিশাল নগরীর দুটি বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লা এবং অভ্যন্তরীণ রুটের বাসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছেনা। উল্টো বাসে গাদাগাদি করে ও দাঁড় করিয়েও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এছাড়া মাস্ক পড়ায় অনীহা রয়েছে অনেক যাত্রীর। লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে পুরোপুরি। সবকিছুই চলছে আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে। এতে করোনা সংক্রামণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন যাত্রীরা। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহনের দাবি করেছেন। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, যাত্রী কম হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি তেমন লঙ্ঘিত হচ্ছেনা। তবে সরকারের নির্দেশনা কার্যকরের চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে তারা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবহন কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কেউ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাঠে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেটরা কাজ করছেন। সংকটে করোনা ওয়ার্ড ॥ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বরিশালের স্বাস্থ্য সেক্টর। গত বছরের মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর যে দুর্বল অবস্থায় ছিলো এখানকার স্বাস্থ্য সেক্টর, বর্তমানে পরিস্থিতি তার চেয়েও করুণ। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না চিকিৎসকরা। গত মাসের ৮ থেকে ১০ মার্চ শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন। বর্তমানে তা ৯০ জনে দাঁড়িয়েছে। এখানে থাকা ১২টি আইসিইউ বেডের সবই পূর্ণ। করোনা ওয়ার্ড সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০ জন রোগী আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন। কিন্তু খালি না থাকায় তাদের আইসিইউ বেড দেওয়া যাচ্ছেনা। বরিশালের স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার জানান, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বরিশাল। বর্তমানে এখানে শনাক্তের হার প্রায় ২৪ ভাগ। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পরবে। ইতোমধ্যে শেবাচিমের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা শনাক্ত হওয়া একজন কলেজ শিক্ষক ও উপর্সগ নিয়ে চিকিৎসাধীন দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। সূত্রমতে, বরিশালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় একমাত্র ডেডিকেটেড করোনা ওয়ার্ড রয়েছে শেবাচিম হাসপাতালে। এখানে করোনা রোগীদের জন্য রয়েছে ১২টি আইসিইউ বেডসহ দুইশ’ শয্যা। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা ধরা পরার পর এ ওয়ার্ডটি চালু করা হয়। শুরু থেকে এ ওয়ার্ডে চিকিৎসক আর চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটে এটি নানা সমস্যার মুখে রয়েছেন। শেবাচিমের পক্ষ থেকে বারবার ঢাকায় চিঠি দেওয়া হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা। শেবাচিম হাসপাতালের ইনডোর ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডাঃ সুদীপ হালদার বলেন, গত বছর আমরা যখন করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেছি তখন অবাক হয়ে দেখলাম রোগীদের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে জরুরি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার একটিও নেই বরিশালে। তাৎক্ষণিক সমাজের বিত্তবানদের কাছে হাত পেতে সংগ্রহ করা হয় ছয়টি ন্যাজাল ক্যানুলা। পরে সরকারিভাবে আসা মিলিয়ে ২২টি ক্যানুলা হলেও এগুলো সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ কোনো জনবল না থাকায় মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তার অধিকাংশই বিকল হয়ে পরেছে। তিনি আরও বলেন, শুধু ক্যানুলা পরিচালনাই নয়; এখানে করোনা ওয়ার্ড ও হাসপাতাল মিলিয়ে যে দুটি আইসিইউ ওয়ার্ড রয়েছে সেগুলো পরিচালনার জন্যও নেই কোনো আইসিইউ স্পেশালিস্ট। করোনা ওয়ার্ডের ২০০ মিলিয়ে ১২শ’ বেডের হাসপাতাল চলছে ৫০০ বেডের জনবল দিয়ে। তাও আবার রয়েছে চিকিৎসকের তীব্র সংকট। এতোবড় একটি হাসপাতালে নেই অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো চিকিৎসক। ডাঃ সুদীপের এ বক্তব্যের সত্যতা জানতে খোঁজ নিয়ে মিলেছে আরও ভয়াবহ তথ্য। শুরু থেকেই এ হাসপাতালে নেই আইসিইউর কোনো স্পেশালিস্ট। ডাঃ নাজমুল নামের একজন অ্যানেস্থেশিয়ার চিকিৎসক সামলাচ্ছেন আইসিইউ। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন প্রশ্নে তার অভিজ্ঞতা শুধুই সাত দিনের একটি প্রশিক্ষণ। তিনি আবার কয়েকজন নার্সকে নিয়েছেন শিখিয়ে পরিয়ে। তারাই দেখভাল করেন আইসিইউতে থাকা রোগীদের। সূত্রমতে, প্রথমবার করোনা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করার পর এখানে প্রেষণে ৪০ জন ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে ৩২ জন মেডিক্যাল কলেজের এবং আটজন বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই তারা যে যার মতো লবিং-তদবির করে ফিরে গেছেন পূর্বের কর্মস্থলে। ফলে চলমান দ্বিতীয় ওয়েভে হাসপাতালে আসতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া প্রশ্নে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডাঃ আবদুর রাজ্জাক বলেন, শেবাচিমের ২২টি ন্যাজাল ক্যানুলার মধ্যে বিকল হয়ে পরা ১০টি মেরামতের জন্য ঢাকায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। অন্য সমস্যাগুলো সমাধানে ঢাকার সহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিচালক নেই। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আমার ক্ষমতা সীমিত। তবু সবসমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
Leave a Reply