দখিনের খবর ডেস্ক ॥ হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সাম্প্রতিক তাণ্ডবের ঘটনায় সংগঠনটি সম্পর্কে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে। তাঁরা ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র নীতির পরিবর্তে এখন সরকারকে আরো কঠোর হতে বলছেন। হেফাজতের কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নীতিনির্ধারকরা চান সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব বিতর্কিত মামুনুল হকের গ্রেপ্তার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে হেফাজত সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তনের কারণে গত তিন দিনে সারা দেশে অর্ধশতাধিক মামলা দায়ের হয়েছে সংগঠনটির উগ্র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধ হওয়া বিতর্কিত হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিগত সম্মতি পেলে ভবিষ্যতে উগ্র এই মৌলবাদী সংগঠনটিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে কৌশল গ্রহণ করতে চান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও নীতিনির্ধারকরা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার নারীনীতি ঘোষণা করলে তার বিরোধিতা করে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের জন্ম হয়। তিনি সংগঠনটির আমির ছিলেন। যেসব দল এই ব্যানারে যুক্ত হয়, তাদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে বাংলাদেশের বিরোধিতা এবং একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। এর মধ্যে ব্লাসফেমি আইন করার দাবিও ছিল। ওই বছরের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমবেত হয়ে তারা ১৩ দফা মেনে না নিলে ঢাকা দখল করে সরকার পতনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু সরকারের শক্ত ভূমিকার কারণে হেফাজতের উগ্র কর্মীরা শাপলা চত্বর ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর মদিনা সনদ বাস্তবায়ন, সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। প্রথম দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। পরবর্তী সময়ে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র নীতি গ্রহণ করে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান হেফাজতে ইসলামের নেতারা। সেই থেকে আওয়ামী লীগের নেতা, সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ভূমিকা পরিহার করে আসছেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে তাণ্ডবের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র নীতির পরিবর্তে এখন হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারে হার্ডলাইন অনুসরণের পক্ষে মত দিচ্ছেন। দলটির বেশির ভাগ নেতার বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নীতির বিরোধিতা করে যে উগ্র সংগঠনের জন্ম, তাঁরা কখনোই তাদের পক্ষে থাকতে পারেন না। তাই সময় থাকতে এখনই তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে বড় ভুল হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত সোমবার তাঁর সরকারি বাসভবনে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হেফাজত নেতার অনৈতিক ঘটনার সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের যে তাণ্ডবলীলা চলছে, তাতে এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। এই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে টার্গেট করেই তারা তাদের পুরনো পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায়। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই অপশক্তিকে (হেফাজতে ইসলাম) প্রতিহত ও পরাজিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব দেশপ্রেমিক মানুষকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। জানা গেছে, নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম যে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে সে ব্যাপারে শুরুতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা নমনীয় ছিলেন। কিন্তু হেফাজতের উগ্র কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ হামলা চালালে সরকারের নীতিনির্ধারকরা তাঁদের মত পাল্টাতে শুরু করেন। তাঁরা দ্রুত কঠোর হতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে পরামর্শ দেন। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেফাজতের কর্মীদের দমনে মাঠে নামে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারায়। নাম প্রকাশ না করে সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার বলেন, হেফাজতে ইসলামের উগ্র কর্মীদের আর মাঠে নামতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে সন্ত্রাস, হামলা, ভাঙচুরের উসকানি ও নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তার করা হবে। তাঁরা (নীতিনির্ধারকরা) সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে রাজি করাতে পারলে যেকোনো সময় হেফাজতের বিতর্কিত নেতা মামুনুল হক গ্রেপ্তার হতে পারেন বলেও জানান তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য গতকাল বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় রিসোর্টে মামুনুল হকের ধরা পড়া এবং তাণ্ডব-পরবর্তী ঘটনা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি অনুকূলে মনে হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামুনুল হককে নিজেদের কবজায় নেবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী গত বুধবার বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি (হেফাজতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড) সঠিকভাবে সামলিয়েছেন।’ আপনারা হেফাজত সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তন করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘হেফাজতের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নাশকতায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক সমঝোতার যে প্রসঙ্গ উঠেছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হেফাজত সাম্প্রদায়িক সংগঠন। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নই আসে না।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গতকাল বলেন, সহিংসতায় জড়িত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সবাইকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, সরকার এরই মধ্যে তাঁদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জামায়াত-শিবির হোক আর হেফাজত বা বিএনপিই হোক, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপশক্তিকে প্রতিহত করা হবে। হেফাজতে ইসলামের এমন তাণ্ডব, অরাজকতা মেনে নেওয়া যায় না। জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আমাদের সরকার যেকোনো মূল্যে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এর ব্যত্যয় কেউ যদি ঘটাতে চায়, সে যে বা যারাই হোক, তাদের বরদাশত করা হবে না। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমাদের সরকার জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় প্রয়োজনে আরো কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে।’
Leave a Reply