আমতলী প্রতিনিধি ॥ বরগুনার আমতলী উপজেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবদেহ, প্রাণিকুল ও কৃষিতে এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ডায়রিয়া বেড়েছে। আউশ আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। জানা গেছে, গত চৈত্র মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে সাগরের লবণাক্ত পানি উপকূলীয় আমতলী-তালতলী সংলগ্ন নদ-নদী, বিশেষ করে পায়রা (বুড়িশ্বর) নদী ও তার শাখা নদীতে প্রবেশ করে। উপরন্তু দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় লবণাক্ত পানি উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মানবদেহ, প্রাণিকুল ও কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মার্চ থেকে গতকাল ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১ হাজার ১৭৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। বেসরকারি হিসাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪ গুণ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল মুনায়েম সাদ বলেন, মানবদেহে লবণের সহনীয় মাত্রা ১৩৮ মিলি মোল/লিটার। প্রচণ্ড তাপদাহ, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও পায়রা (বুড়িশ্বর) নদীর পানিতে রোটা ও ভিবিও কলেরা ভাইরাসের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। ওই পানি যারাই ব্যবহার করছেন তারাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অপরদিকে, পায়রা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে উপকূলীয় কৃষক পরিবারের মাঝে। লবণাক্ত পানিতে নিম্নাঞ্চলের রবি ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আগামী আউশ চাষে বিপত্তি ঘটার। প্রতিটি অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে লবণ-পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাটিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার সৃষ্টি হয়। এতে কৃষক আউশ ধানের বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। আগামী মৌসুমে আউশ ধানের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। দ্রুত নদ-নদীর লবণাক্ততা দূর না হলে উপকূলীয় অঞ্চলের জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন সচেতন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। আমতলী উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, নদী-খাল-বিলের পানিতে শুধুই লবণ আর লবণ। এ কারণে আউশের বীজতলা প্রস্তুত করতে পারছি না। লবণপানি দিয়ে জমিতে সেচ দিলে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাবে। উপজেলা কৃষি অফিসার সি এম রেজাউল করিম বলেন, কৃষি জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা চার ধরনের। প্রথম মাত্রা ০-২ ডিএস/মিটার, মধ্যম মাত্রা ২-৪ ডিএস/মিটার, উচ্চ মাধ্যম ৪-৬ ডিএস/মিটার এবং সর্বোচ্চ ৬-৮ ডিএস/মিটার। প্রথম, মধ্যম মাত্রায় ফসল সহনশীল। উচ্চ-মধ্যম মাত্রার লবণে কিছু ফসল হলেও সর্বোচ্চ মাত্রার লবণাক্ত জমিতে ফসল হয় না। তিনি জানান, পায়রা (বুড়িশ্বর) নদী ও শাখা-প্রশাখা নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় আগাম আউশ আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে বীজতলা প্রস্তুত করলে বীজ নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, উপজেলায় আগে থেকেই ৫৫০০ হেক্টর জমি লবণাক্ত রয়েছে। এর ওপর গত ১ মাস ধরে পায়রা (বুড়িশ্বর) নদীর লবণাক্ত পানি খাল, নদী-নালায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ জমির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে জানান। আমতলী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার মোসা. হালিমা সরকার বলেন, পায়রা (বুড়িশ্বর) নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করার পরপরই পানিতে লবণের মাত্রা পরীক্ষা করেছি। তাতে পায়রা নদীর পানিতে লবণের মাত্রা ৩.০৫ পিপিটি। এতে নদীর মাছের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। লবণের মাত্রা ৬ পিপিটির ওপরে উঠলে পায়রা নদীতে বসবাসরত মাছের জন্য ক্ষতিকর। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার আলম বলেন, ফারাক্কা বাঁধ কর্তৃপক্ষ পানি না দেওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে উজানের পানির চাপ নেই। ফলে সাগরের লবণাক্ত পানি নদ-নদীর শাখা-প্রশাখায় প্রবেশ করছে। তিনি আরো বলেন, গত ২৫ বছরে শাখা নদীগুলোতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত বুধবার এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে সাধারণত বৃষ্টি, কালবৈশাখী, এমনকি শিলাবৃষ্টির আগমনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলা বছর শুরু হয়। কিন্তু এ বছর এর ব্যত্যয় ঘটেছে। বাংলা নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ চললেও দেশের বেশির ভাগ স্থানে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অনেক জায়গায় বৃষ্টির দেখাই মেলেনি। প্রকৃতির এই অস্বাভাবিকতায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। এর ফলে বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সাতক্ষীরা ও বরগুনার মতো উপকূলীয় জেলাগুলো মারাত্মক পানিসংকটে পড়েছে। পুকুরের মতো মিঠা পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলের পানিও দিন দিন কমে আসছে। দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে বেড়েছে ডায়েরিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, ইউরিন্যাল ইনফেকশন, চর্মরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, যৌনাঙ্গে চুলকানি ও ঘায়ের মতো রোগ। নারীদের মধ্যে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন- টিউমার ও জরায়ুর ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
Leave a Reply