অনলাইন ডেস্ক ॥ সরকারি হাসপাতালে ২০ টাকার টেস্ট বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ২০০ টাকা। এই হিসেবে পার্থক্য দ্বিগুণ নয়, দশ গুণ। তাই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল চক্র কমিশনের জন্য ওৎ পেতে থাকে রোগি ধরার জন্য। তাদের দৌরাত্ম্যে বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি ক্রমশই বাড়ছে। রোগির নাম ইম্পা আক্তার, নগরীর নবগ্রাম রোডে বাসিন্দা তিনি। জেনারেল হাসপাতালে গত ৫ মে এসেছিলেন গাইনি চিকিৎসক দেখাতে। হাসপাতালের টিকেট কাটার পর থেকেই তার টিকেট লুফে নিয়ে ‘ডাক্তার ও সহজে টেস্ট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে কব্জা করে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারী সোনালী আক্তার। সোনালীর মতো একজন নয়, প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ৩ থেকে ৫ জন করে দালাল কমিশন বা মাসিক বেতনে নিয়োগ দেওয়া আছে। রোগি ধরা এই দালালদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালকরা ‘মার্কেটিং বিভাগের লোক’ বলে অভিহিত করেন। হাসপাতালের এ চিত্র নগরীর জেনারেল হাসপাতালের একদিন বা দু’দিনের নয়, বহু বছরের। অনৈতিক লাভের আশায় একে একে ৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে এই হাসপাতালের সামনে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়াতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ধোপে টেকে না। সেসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে সুযোগ বুঝে ইচ্ছামাফিক টেস্টের ফলাফল প্রকাশেরও অভিযোগ রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, এই হয়রানি থেকে রোগিদের রক্ষা করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেনারেল হাসপাতালের টেকনোলজিস্টরা বলেন, ‘পরীক্ষার বেলায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে দশগুণ বেশি টাকা নেওয়া হয়। যেমন প্রসাব রুটিন পরীক্ষা সরকারি ফি ২০ টাকা, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয় ২০০ টাকা। সিরাম ক্রিয়েটিনিন ৫০ টাকার বেলায় নেয় ৩০০ টাকা। ব্লাড সুগার টেস্টের সরকারি ফি ৬০ টাকা, মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তা ২০০ টাকা। সিবিসি টেস্ট ১২০ টাকারটা নিয়ে থাকে ৫০০ টাকা। এছাড়া জেনারেল হাসপাতালে ইসিজি পরীক্ষায় ফি নেয় ৮০ টাকা, এই টেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয়া হয় ৩০০ টাকা, (হাফ) আল্ট্রাসাউন্ড ৭০০ টাকা আর হোল আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার সরকারি ফি ২১০ টাকা। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে থাকে ১২০০ টাকা। জেনারেল হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসব পরীক্ষায় নানা অনিয়মের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন জেনারেল হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ম অনুযায়ী টেকনোলজিস্ট বা টেস্টের ফলাফল দেখার জন্য নির্ধারিত প্যাথলজিস্ট না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারীরাই স্বাক্ষর দিয়ে রোগির হাতে ধরিয়ে দেয়। এমনও ঘটে, এক টেস্টের বেলায় আরেক টেস্ট করিয়ে সুযোগ বুঝে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। জেনারেল হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল চক্রের বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন এই হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জন ডা. ত্বন্নী। তিনি বলেন, ‘টিকেট কাটা রুমের সাথেই তার কক্ষ। বিশেষ করে দরিদ্র, অক্ষরজ্ঞানহীন রোগিদের পেলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা টিকেট কাটতে সহায়তা এবং ডাক্তার দেখানোর কথা বলে সুযোগ নেয়। এরপর ইচ্ছা অনুযায়ী টেস্ট করায়ে রোগির কাছ থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয়।’ ‘এক রোগিকে টেস্ট করতে দিলে তা এই হাসপাতালে থাকলেও দালালের খপ্পরে পড়ে ওই রোগিকে সামনের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট করাতে বাধ্য করা হয়। এতে গরীব ওই রোগির বাড়তি টাকা খরচ হয়েছে দেখে কর্তৃপক্ষকে জানালে দালালদের বেশ কয়েকবার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল। তবে এই চক্রটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের বলে বলিয়ান হওয়াতে তা কোনো কাজে আসেনি, বলেও জানান তিনি। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয়কৃষ্ণ বড়াল জানান, তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল প্রতিরোধে একটি পরিকল্পনা করেছেন যা সপ্তাহখানিকের মধ্যে চালু করবেন। রোগিদের টিকেটের গায়েই লিখে দেবেন হাসপাতালের কোন কক্ষে কোন টেস্ট করা হয়। এতে যদি কিছুটা সমাধান মেলে। জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জেলার সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, হাসপাতালের টেস্টের মান ভালো না, সুযোগ বুঝে এমন অপপ্রচার চালিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে রোগিদের বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিতেই থাকবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের হাতে রোগিদের হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি নগর পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করেছি। এমনকি জেলার মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় তোলায় এ নিয়ে রেজুলেশনও হয়েছে। জেলা প্রশাসক আমাকে আশ্বস্ত করেছেন ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের দালাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।’
Leave a Reply