নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ রহস্যঘেরা মৃত্যুবরণকারী শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ এমএ আজাদ সজল ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইমাম বাড়ি কবরস্থানে শায়িত হলেও বরিশালের পুলিশের সামনে রেখে গেছেন একটি জিজ্ঞাসাবোধক প্রশ্ন। আদৌ তার মৃত্যু কি নিছক কোন দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড, তা নিশ্চিত হতে বরিশালের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একাধিক সংস্থা এই রহস্য উম্মোচনে মাঠে কাজ করলেও ঘটনার পাঁচদিন পরেও কোন ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেননি। প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে হত্যা হিসেবে ধরে নিলেও নিশ্চিত হতে পারছে না কিভাবে ঘটলো এই বিয়োগান্তর ঘটনা। নগরীর কালীবাড়ি সড়কের অত্যাধুনিক মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের একাধিক কর্মচারীদের কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রাখলেও এখনও রহস্যের কোন কিনারায় পৌঁছানো যায়নি।
কোতয়ালী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) এমআর মুকুল জানান, খুব শীঘ্রই ঘটনার মুল রহস্য উম্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘটনার তদন্ত করা নির্ভরযোগ্য একটি বাহিনীর সূত্রমতে, গত ২৭ এপ্রিল বিকেলে মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিচে নেমে বাজার করে উপরে ওঠার পর থেকে ডাঃ আজাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরই তার মৃত্যু হয়েছে, নাকি গভীর রাতে কোন একসময় তার জীবন কেড়ে নিয়ে তা আঁড়াল করতেই ওই হাসপাতালের লিফটের নিচে তার রক্ত ভেজা দেহ রাখা হয়েছিল। যদিও হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ জহিরুল হক মানিক তার সহকর্মী চিকিৎসক আজাদের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছেন।
সূত্রমতে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সহকারী অধ্যাপক) ডাঃ এমএ আজাদ সজল মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রাইভেট প্রাকটিসের পাশাপাশি সেখানকার সপ্তম তলার ৮ নম্বর কক্ষে বসবাস করতেন।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ফার্মেসির কর্মচারী হাসানের দাবি, বিকেল পাঁচটার পর ডাঃ সজল নিচে নেমে বাজার করে কিছু অংশ তার কাছে দিয়ে একটি টুথপেক্ট ও কিছু পেঁয়াজ নিয়ে উপরে ওঠার আগে তার কক্ষে ইফতারি দেয়ার জন্য বলেন। কক্ষে যেতে তিনি লিফটে কখন উঠেছিলেন তা তিনি দেখনেনি। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, লিফটে উঠতে গিয়েই অসতর্কবসত ডাঃ আজাদ নিচে পরে মারা যান। প্রশ্ন উঠেছে, যদি তাই ঘটে তবে চিকিৎসকের হাতে থাকা সেই টুথপেষ্ট ও পেঁয়াজের থলে লিফটের ভিতর স্বাভাবিকভাবে পাওয়া গেল কিভাবে? এতে প্রমাণ করে ডাঃ আজাদ তার থাকার কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। তালাবদ্ধ কক্ষ খুলেও পুলিশ সবকিছুই স্বাভাবিক দেখতে পেয়েছেন।
সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, সার্বিক আলামতে ধারণা করা হচ্ছে ডাঃ আজাদ লিফটের ভিতরেই ছিলেন। সেখান থেকে কেউ তাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে ওই হাসপাতালের ভিতরেই কোন কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। রাতের গভীরতায় কোন একসময় তাকে হত্যা করা হয়। কারো একার পক্ষে এই ঘটনা সংঘটিত করা সম্ভব নয়। লিফটের নিচে লাশ ফেলে রাখাও হয়েছিল পরিকল্পনা মাফিক। সেক্ষেত্রে লিফট নিয়ন্ত্রণকারী ট্যাকনিশয়ান এ বিষয় কম-বেশি অবগত থাকতে পারেন। কারণ লিফট ওপরে উঠে গেলে নিচে বন্ধ দুয়ার খুলতে চাবির প্রয়োজন। সেই চাবি স্বাভাবিকভাবেই ট্যাকনিশিয়ানের কাছে থাকার কথা। আবার এতো বড় একটি হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের আসা যাওয়া এবং কর্মচারীদের ঘোরাঘুরিও মাঝে কিভাবে এ ঘটনার সমাপ্তি টানা হলো তাও প্রশ্নবিদ্ধ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে দুর্ঘটনার কথা দাবি করছে, তা সার্বিক বাস্তবতায় এখন ধোপে টিকছেনা। তবুও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত হতে সময়ের সাথে গভীরভাবে জোরালোভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাঃ আজাদের হত্যাকান্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তোড়জোর চোখে পরার মতো। শুধু থানা পুলিশ নয়, গোয়েন্দা টিম ও পিবিআইসহ র্যাবের গোয়েন্দা শাখাও বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি দুর্ঘটনা বলা হলেও আসলে তা নয়, তার প্রমাণ বহন করে লাশের দেহের বিভিন্নঅংশে জখমের ধরন দেখে। তবে ময়নাতদন্তের রির্পোট না আসায় এখনও নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। লাশের সুরাতহালের সময় উপস্থিত ডাঃ আজাদ ছোট ভাই ডাঃ শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস সাংবাদিকদের জানান, নিহতের ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে হাড় ভেঙে বেড়িয়ে গেছে। বাম পায়ের তালুর নিচে মাংস নেই। বুকের হাড় ভাঙ্গা দেখা গেছে। তার ধারণা লিফটের নিচে রেখে চাঁপা দিয়ে ঘটনা আঁড়াল করতেই সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল। তিনি এই মৃত্যুকে হত্যা বলে দাবি করে লাশ উদ্ধারের সময়কাল ২৮ এপ্রিল রাতে কোতয়ালী মডেল থানায় বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
Leave a Reply