বরগুনা প্রতিনিধি ॥ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বরগুনায় জলোচ্ছ্বাসে ছয় উপজেলার ১ হাজার ২৪৯টি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। যার আয়তন ৭৪ হেক্টর। পুকুর ও ঘের মিলিয়ে ৬০ টন মাছ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। এতে ১ কোটি ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে টানা তিন দিনের অতি জোয়ারে বরগুনার বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। এতে জেলার কৃষি ও মাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা সূত্রে জানা গেছে, বুধবার (২৬ মে) সকালে বরগুনার নদ-নদীতে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৬৮ মিটার এবং রাতের জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৪৮ মিটার। ইয়াস চলে গেলেও পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা কমেনি, বরং বৃহস্পতিবার (২৭) সকালের জোয়ারে তা বেড়ে গেছে। এছাড়া জেলায় মাছের ঘের ও পুকুরে চাষ করা মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে মাছের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২ লাখ টাকার। শুক্রবার (২৮ মে) দুপুর পর্যন্ত অতি জোয়ারের তোড় অব্যাহত ছিল। এদিনও বাঁধভাঙা জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে জনজীবনে ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের দাবি, সিডরের মতো সুপার সাইক্লোনের পর দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার পদক্ষেপ না নেয়ায় ইয়াসে তাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সম্পদ। বুধবার (২৬ মে) ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের উত্তর উপকূলে ইয়াস আঘাত হানার পর ধারণা করা হয়েছিল নদ-নদীর জোয়ারের পানির উচ্চতা কমে আসবে। কিন্তু পূর্ণিমার কারণে বৃহস্পতিবারও বরগুনার তিনটি নদীতে পানির প্রবাহ বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রবল জোয়ারের তোড়ে বরগুনার বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলের মাঠ ও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে রোপা-আউশসহ কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বোরো ধানের বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। এছাড়া ঘের তলিয়ে চাষিদের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। গত বুধবার রাতের জোয়ারের প্রবল তোড়ে বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙে লোকালয় ও ফসলের মাঠে পানি প্রবেশ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইয়াসের প্রভাবে গত কয়েক দিনে বরগুনার পায়রা বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পানি বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার (২৭ মে) দুপুরেও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। শুক্রবার (২৮ মে) সকালে পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের মাঠ পানিতে নিমজ্জিত। বাঁধ ভেঙে প্রবল স্রোত ফসলের মাঠে প্রবেশ করছে। এলাকার তিনটি বিশাল ফসলের মাঠ জোয়ারের পানিতে থই থই। বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, আউশের আবাদ করণের লাইগ্যা মুই ২০ কাডি ধান বীজতলা বানাইতে ক্ষেতে হালাইছিলাম, সব পানিতে ভাইস্যা নষ্ট অইয়া গ্যাছে। মোগো এইফির আর আউশ ধান ঘরে ওডবে বইল্যা মনে অয় না। পদ্মা এলাকার কৃষক জাফর সরদার রহমান বলেন, মনে করছিলাম বইন্না চইল্লা গ্যাছে, পানি কইম্মা যাইবে, রাইতের আর বেইন্নাকালের জোয়ারে বইন্নার সোমায়ের চাইতেও বেশি পানি ওঠছে, মোগো খ্যাতখামার, মাছের ঘের সব শ্যাষ। আউশ ধান এইবার আর ফলাইতে পারমু না, ঘরে এবার ধান ওডবে না।’ পাউবো বরগুনার পানি পরিমাপক মো. মাহতাব হোসেন বলেন, বুধবার রাতে যদিও জোয়ারের পানির উচ্চতা কিছুটা কম ছিল, কিন্তু বৃহস্পতিবার দিনের জোয়ারে তা বেড়েছে। বৃহস্পতিবারের জোয়ারে বরগুনার তিনটি নদীতে গড়ে জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৭৫ মিটার। ইয়াস শুরুর পর যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব জানান, ইয়াসের কারণে বরগুনায় জলোচ্ছ্বাসে ছয় উপজেলার ১ হাজার ২৪৯টি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে, যার আয়তন ৭৪ হেক্টর। পুকুর ও ঘের মিলিয়ে ৬০ টন মাছ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১ কোটি ২ লাখ টাকা। এছাড়া বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ব্রাইট অ্যাগ্রো সার্ভিসের বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা ৬০ হাজার টাকা মূল্যের কই মাছ বিদ্যুৎ না থাকায় মারা গেছে। মৎস্য বিভাগ জানায়, সবচেয়ে বেশি মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তালতলী উপজেলায়। এখানে ৬৯৯টি মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। আমতলী উপজেলায় ২৪০টি, বরগুনা সদর উপজেলায় ১২৫টি এবং ১৫৫টি ঘের ও পুকুরের মাছের ক্ষতি হয়েছে। বরগুনার বুড়িরচর ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা আমিন জানান, তার ঘেরের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ জোয়ারে প্লাবিত হয়ে ভেসে গেছে। একই এলাকার জুলফিকার শাহীন জানান, তার ঘেরের ১২ লাখ টাকার মাছ জোয়ারের তোড়ে ভেসে গেছে। পাউবো বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাউবো বরগুনার ২০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বাঁধগুলো দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে আমরা কম উচ্চতার বাঁধগুলো দুর্যোগ সহনশীল উচ্চতাসম্পন্ন করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এদিকে, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনা জেলা কার্যালয়ের তথ্যমতে, বরগুনায় মৌসুমে ১৮৫ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করে বীজতলা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এছাড়া বীজ বপন করা হয়েছিল ৭৭২ হেক্টর জমিতে। জোয়ারের পানির তোড়ে তৈরি বীজতলার নব্বই ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বপন করা বীজের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে কত টাকার আউশের আবাদ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে পারেনি কৃষি বিভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, এখন পর্যন্ত জোয়ারের পানিতে বিভিন্ন এলাকার বীজতলা প্লাবিত রয়েছে। যে কারণে আমাদের আউশের ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া মোট কত টাকার কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে, পানি কমার পর তা নিরূপণ সম্ভব হবে। কৃষি বিভাগ আরও জানায়, ইয়াসে বরগুনার ৪৩টি পানের বরজ, ৭ হেক্টর জমির মরিচ, ৮ হেক্টরের পেঁপে, ১৭ হেক্টর জমির হলুদ ও ২৩১ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বরগুনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) হাবিবুর রহমান বলেন, ইয়াস ও পূর্ণিমার জোতে সৃষ্ট জোয়ারের জেলার বিভিন্ন স্থানের বাঁধ ভেঙে ও উপচে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরূপণের জন্য বলা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেবো। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমরা আপৎকালীন সহায়তা হিসেবে পানিতে প্লাবিত এলাকাগুলোতে শুকনো খাদ্য বিতরণ করেছি।
Leave a Reply