বরগুনা প্রতিনিধি ॥ বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দে দোল খায় সবুজ ঝাউবন। যেখানে ঝাউগাছগুলো ‘শুভসন্ধ্যা’র সৌন্দর্য বর্ধন করতো। সৌন্দর্য দেখতে যেখানে হাজারো মানুষের ভিড় জমতো, সেখানে আজ অগণিত জীবন্ত গাছের মৃত্যুর মিছিল দেখছে সবাই। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জলরাশি ‘শুভসন্ধ্যা’ সমুদ্র সৈকত। বালুময় দীর্ঘ সৈকত ঝাউবনের সবুজ সমীকরণের এ দৃশ্যটি যেন প্রকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করা যায়। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ছোবলে শুধু ‘শুভসন্ধ্যা’ই লণ্ডভণ্ড হয়নি, লণ্ডভণ্ড হয়েছে বঙ্গোসাগরের তীরবর্তী প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন ফকিরহাটের টংরাগিরি, নিশানবাড়িয়া, পাথরঘাটার হরিণবাড়িয়া, বিহঙ্গদ্বীপ পর্যটন কেন্দ্র। এর আগে গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও শুভসন্ধ্যার ১০ হেক্টর সৈকতের প্রায় ২৫ হাজার ঝাউগাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে, ভেঙে গিয়েছিল পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য নির্মিত রাস্তাও। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গোসাগরের তীরবর্তী প্রকৃতির অপরূপ লীলানিকেতন ফকিরহাটের টংরাগিরি, নিশানবাড়িয়ার শুভসন্ধ্যা ও পাথরঘাটার হরিণবাড়িয়া পর্যটন কেন্দ্র ইয়াসের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নের ফকিরহাটের টেংরাগিরি বনাঞ্চল, একই উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়ার শুভসন্ধ্যা এবং পাথরঘাটার হরিণঘাটা ও বিহঙ্গদ্বীপ পর্যটন কেন্দ্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে সৌন্দর্য্য হারিয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল টেংরাগিরির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে শুভসন্ধ্যা। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে শুভসন্ধ্যার প্রায় ৫০ ফুট প্রস্থ ও ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ঝাউবন। যে ঝাউবনটি ছিলো শুভসন্ধ্যার প্রধান সৌন্দর্য। এছাড়াও হরিণঘাটা ও বিহঙ্গদ্বীপের অনেক গাছ উপরে গিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর এখানে উপমহাদেশের সব চেয়ে বড় জোছনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব ঘিরে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। তাছাড়া প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসতো। সমুদ্রের মূল আকর্ষণ ছিল ঝাউবন। বিভিন্ন দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ঝাউবন বিলীনের পথে। সিডর, আয়লা, নারগিস, বুলবুল,আম্পানসহ বড় বড় দুর্যোগকে মোকাবিলা করেছে এই বন। বনের কারণে রক্ষা পেয়েছে উপকূলবাসী। উপকুলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেছে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনি। ম্যানগ্রোভ বন উপকূলকে সব সময় রক্ষা করে আসছে। আর সেই রক্ষা কবজই ইয়াসের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এই বন না থাকলে উপকূলকে বাচাঁনো সম্ভব হতো না বলে মনে করছেন এলাকার সচেতন মহল। তালতলী রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পাওযায় টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা, বিহঙ্গদ্বীপ ও হরিণঘাটা বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের তীরবর্তী প্রায় দেড় কিলোমিটার পাড় ভেঙে গেছে ও নদীর পানির সঙ্গে ভেসে গেছে অনুমানিক ছয় হাজারের বেশি গাছ। বরগুনার পর্যটন উদ্যোক্তা সাংবাদিক সোহেল হাফিজ ও আরিফুর রহমান বলেন, বরগুনা জেলা পর্যটনপ্রেমীদের একটি অভ্যয়ারণ্য। শুভসন্ধ্যা, হরিণঘাটা, ইকোপার্ক, বিহঙ্গদ্বীপ বনাঞ্চলসহ কালমেঘা পর্যটন কেন্দ্র ও নীলিমা পয়েন্ট পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত শুভসন্ধ্যাসহ পর্যটন স্পটগুলো আগের পরিবেশে ফিরিয়ে আনা দরকার। সারা বছরই এই সমুদ্র সৈকত দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আসতেন। চলমান করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ পর্যটনকেন্দ্রগুলো। পর্যটকদের যেমন ছিল সমুদ্রপ্রিয়তা তেমনই প্রিয় ছিলো মনমুগ্ধকর ঝাউবন। সেই উপকূলের সৌন্দর্য্য লুকিয়ে থাকতো যে ঝাউবনের ভেতর, সেই ঝাউবনের সৌন্দর্য ইয়াসের তাণ্ডবে হারিয়ে গেছে। উপমহাদেশে ‘জোছনা উৎসব’ হয় এই ‘শুভসন্ধ্যা’য়।
Leave a Reply