স্টাফ রিপোর্টার ॥ একের পর এক উদ্ভাবনে দেশব্যাপী তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশবের স্মৃতি বিজরিত বিদ্যাপীঠ জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার সরকারি গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশব্যাপী আলোচিত ওই বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর পৃথক রোবট উদ্ভাবনের পর এবার একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোসলেউদ্দীন সাহান উদ্ভাবন করেছেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে “স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট”। উদ্ভাবনের বিষয়ে সাহান বলেন, আমাদের দেশে মূলত কয়লা, পিচ ও বিটুমিন দিয়ে সড়ক কিংবা রাস্তা নির্মাণ করা হয়। যখন কয়লা পিচ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়, তখন অবশ্যই কয়লা ও পিচ পোড়াতে হয়। এগুলো পোড়ালে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন গ্যাস যেমন: কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো ধরনের পদার্থ ব্যবহার করা হয়না। রাস্তা তৈরি করতে ন্যানোটেকনোলজি দ্বারা তৈরিকৃত সোলার সেল ব্যবহার করা হয়। যা খুবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। সাহান আরও বলেন, স্মার্ট সোলার হাইওয়ে হচ্ছে একটি পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। এই রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে এটা যেকোনো মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। তাছাড়া এ রাস্তা তিনটি উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। যেমন-সূর্যের আলোর মাধ্যমে, মানুষের চলাচলের সময় যে ঘর্ষণ হয় তার মাধ্যমে এবং মানুষ ও গাড়ির প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে। সাহান বলেন, আমরা যদি এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করি তাহলে একই রাস্তা থেকে একই সময়ে আমরা তিনটি উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং রাস্তা হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবো। উদ্ভাবক সাহানের মতে, সূর্যের আলোর মাধ্যমে এরকম দুই কিলোমিটার রাস্তায় বছরে ৬ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া মানুষের চলাচল ও গাড়ির প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে পিজো ইলেকট্রিক এফেক্টের মাধ্যমে আলাদাভাবে আরও ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। উদ্ভাবক সাহান বলেন, প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা এ রাস্তায় প্রাথমিক অবস্থায় ৩০ টন পর্যন্ত চাঁপ নেয়া সক্ষম। আর সোলার হাইওয়ে দিয়ে যখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তখন মানুষের তড়িৎপৃষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ এখানে সেমি পারমিত্রবেল ম্যাট্রিক্স টেকনোলজি, পলিক্লিস্টালিন টেকনোলজি এবং পলিকার্বনেট টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। যেকারনে ঘর্ষণের সময় যে ইলেকট্রনের ক্ষয় হয় তা দ্বারা মানুষের তড়িৎপৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রেসারকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে রাস্তার উপর দিয়ে কি পরিমাণে গাড়ি চলাচল করছে এবং কি পরিমানে প্রেসার পরছে তার উপর। সাহান আরও বলেন, আমরা যদি এ স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করি তাহলে একই রাস্তা থেকে একই সময়ে আমরা তিন উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করতে পারবো এবং রাস্তা হিসেবেও আমরা ব্যবহার করতে পারবো। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকার প্রতি এক কিলোমিটার রাস্তার জন্য ছয় কোটি টাকা খরচ করে কিন্তু স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করতে প্রতি কিলোমিটারের জন্য চার কোটি টাকাই যথেষ্ট। তাছাড়া পিচের রাস্তার যে স্থায়িত্ব তা হওয়ার কথা হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ বছর কিন্তু তার স্থায়ীত্ব দেখা যায় খুব কম। কারণ বিটুমিনের সব চেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে পানি। বিটুমিন যখনই পানির সংস্পর্শে আসে তখনই দেখা যায় পিচ বা কয়লার তৈরি রাস্তা ভাঙ্গতে শুরু করে। কিন্তু এ স্মার্ট সোলার হাইওয়ের এধরনের কোন ক্ষতিকারক দিক নেই। কারণ এ রাস্তা তৈরি করতে কোন ধরনের পিচ বা কয়লার ব্যবহার করা হচ্ছেনা। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপায়ে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করা হয়। এ রাস্তা সাশ্রয়ী এই কারনে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে ২০১৭ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতের জন্য বাজেট করা হয় ২১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট করা হয় ২৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাজেট করা হয় ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিবছরই বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ও খনিজ খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিমান বেড়েই চলছে। তাই স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তৈরি করলে প্রতিবছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য সড়ক ও জনপথ খাতে আলাদাভাবে বাজেট করতে হবেনা। কারণ এখানে একটা রাস্তার পেছনে সামান্য কিছু ব্যয় করে, একই রাস্তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং রাস্তা হিসেবেও ব্যবহার করা হবে। ফলে সরকারের ও জনগণের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং প্রতিবছর আলাদা আলাদা রাস্তার জন্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের জন্য আলাদাভাবে বাজেট বরাদ্দ করতে হবেনা। ফলে প্রতিবছর সড়কের জন্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় সেই বাজেটের অর্থ অন্যান্য খাতকে সমৃদ্ধ করতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে খনিজ সম্পদ অর্থাৎ তেল-গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার উপরও চাপ কমবে। কারণ স্মার্ট সোলার হাইওয়েতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোনধরনের তেল বা গ্যাস ব্যবহার করা হয়না। যাতে করে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হয় সেজন্য ভবিষ্যতে এ স্মার্ট সোলার হাইওয়ে আরও বেশি উন্নীতকরণ করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে সাহান বলেন, ভবিষ্যতে এই স্মার্ট সোলার হাইওয়েতে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ডাস্ট সেন্সরসহ আরও কিছু প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে। যাতে করে মানুষ আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া এই স্মার্ট সোলার হাইওয়ের আশেপাশের প্রতিটি বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটিস্থানের যতগুলো ইলেকট্রিক লাইন আছে সবগুলি স্মার্ট ফোনের সাহায্যে কন্ট্রোল করা যায়। এ রাস্তাটি তৈরি করতে মোসলেউদ্দীন সাহানের প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেলে এই রাস্তাটি নিয়ে আরও কাজ করতে চায় মেধাবী ছাত্র সাহান। আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডাঃ মোকলেচুর রহমানের পুত্র ও গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোসলেউদ্দীন সাহান ২০১৬ সালে সরকারি গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছিলেন। তার প্রজেক্টের মূল কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে। তিনি ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সরকারি গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ এবং ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মাহিলাড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। মেধাবী ছাত্র মোসলেউদ্দীন সাহান ২০১৭ সালে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এবং ২০১৫ সালে উপজেলা পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় প্রথমস্থান অধিকার করেন। জাতীয় পর্যায়ে বছরের সেরা মেধাবী নির্বাচিত হয়ে পদক লাভ করেন। ২০১৯ সালে উপজেলা, বরিশাল মহানগর ও বিভাগীয় পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় প্রথমস্থান অধিকার করে এবং জাতীয় পর্যায়ে বছরের সেরা মেধাবী নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে ৩৮তম জতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় প্রথমস্থান অধিকার করেন। ২০১৭ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রথমস্থান অধিকার করেছিলেন। সাহান ২০১৮ সালে জাপান সরকারের আমন্ত্রণে সাকুরা সায়েন্স অ্যাকসেন্স প্রোগ্রামে আটদিনের জন্য অংশগ্রহণ করেন। মেধাবী কলেজ ছাত্র মোসলেউদ্দীন সাহানের বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট উদ্ভাবনের ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক মোঃ জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, মোসলেউদ্দীন সাহানের এ উদ্ভাবন বাংলাদেশকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার এই উদ্ভাবনকে আরও আধুনিকভাবে তৈরি করার লক্ষ্যে সে (সাহান) চাইলে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া সাহানের উদ্ভাবনের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে বলেও তিনি (জেলা প্রশাসক) উল্লেখ করেন।
Leave a Reply