দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ১৯৭০ সালের বন্যার পরে পটুয়াখালীর লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে তারই নির্দেশে জাতীয়করণ হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ৪শ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে জরাজীর্ণ একটি ভবনে জোড়াতালি দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গতবছর করোনার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এতে কিছুটা আশার সঞ্চার হয় স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। কিন্তু সেই আশা পূরণের আগেই এখন গলার কাঁটা ও মরণ ফাঁদ হয়ে আছে নতুন ভবনের জন্য মাটি তোলা গর্ত ও আগের পুরাতন ভবন। বর্তমানে বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শাহিন মাহমুদ, ভবন নির্মাণ শুরুর আগে স্কুলের আশপাশের সবার সমঝোতায় নির্মাণ কর্তৃপক্ষকে জায়গা বুঝিয়ে দেন। সে অনুযায়ী লেআউট প্ল্যান অনুযায়ী বেইজ ঢালাই শেষ করে। কিন্তু মাঝ পথে এসে স্থানীয় দখলদারদের মামলা জটিলতায় নতুন ভবনের বেইজ তৈরি অবস্থায় আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ আছে নির্মাণকাজ। আব্দুল মোতালেব নামে স্কুলের পাশের এক বাসিন্দা পটুয়াখালী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় আদালত উক্ত বিরোধীয় ভূমিতে নির্মাণকাজ স্থগিত রাখার আদেশ দেন মর্মে জানা গেছে। মামলা নং ৪২১/২০২১। ফলে বেইজের গর্তের পাশের বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে, যেকোন সময় ধসে পরতে পারে আগের ইটের গাঁথুনির ভবনটি। পাশাপাশি যে স্থানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে বিদ্যালয়ের তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটি ট্রিনশেট ভবন ছিলো, যা নতুন ভবন নির্মাণ করার কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এমন অবস্থায় করোনার দীর্ঘ ছুটির পর বিদ্যালয় খুললেও শ্রেণি কক্ষের সংকট দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও নতুন ভবনের জায়গায় পনের ফুটেরও বেশি গভীর কুয়ায় পানি জমে থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হয়েছে মরণ ফাঁদ। রড, মাটি ও পঁচা পানির গন্ধে স্কুলটিতে দশ মিনিটের বেশি দাঁড়ানো যাচ্ছে না। এর মধ্যেই ক্লাস করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এদিকে সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। জানা যায়, বিদ্যালয়ে এক কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করার কথা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের। পরে স্কুলের জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাশিদা বেগম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর জমি বুঝিয়া পাওয়ার জন্য আবদেন করলে ইউএনও ভূমি কর্মকর্তাকে জমি বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য বলেন। উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করে ২০২০ সনের ৪ মার্চ স্কুল কর্তৃপক্ষকে জমি বুঝাইয়া দেওয়ার ৭ দিন পরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শুরুর এক মাস যেতে না যেতেই স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মোতালেব বাদী হয়ে সহকারী জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত চলমান নির্মাণকাজে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। নিষেধাজ্ঞা জারির পরে দীর্ঘ ছয় মাস ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। শহরের মিঠাপুকুরের বাসিন্দা মাসুদা বেগম বলেন, দীর্ঘ দেড় বছর পরে আমার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছি। এসে দেখি স্কুলের অবস্থা খুব বিপদজনক। আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি।
কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, আমার মেয়ে এই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। স্কুল ছুটি হবে তাই মেয়েকে নিতে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি স্কুলের উত্তর পাশে মাটি নেই যেকোনো সময় স্কুল ধসে পরতে পারে। এ অবস্থায় আমার মেয়েকে স্কুলে পাঠানো অসম্ভব। ভবন নির্মাণ কাজের ঠিকাদার রানা মিয়া বলেন, একটি স্কুলের উন্নয়নে ভবন নির্মাণের কাজ করছিলাম, এরই মধ্যে বাধা দেওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণসামগ্রীতে (রড) মরিচা ধরছে। মালামালগুলো পরে থাকায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করা হয়। ভবনের ভিম বসাতে মাটি কেটে বেইজ ডালাই দেওয়ার পর আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ করে ঠিকাদার। এর পর দীর্ঘ ছয় মাস এভাবেই পরে আছে। বর্তমানে দ্বীতল ভবনের পাশে গর্ত থাকায় ভবনটি হুমকির মুখে রয়েছে। বিদ্যালয় খোলার কারণে শিশুরা যেকোনো সময় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে। আমাদের ১৫ জন শিক্ষকসহ ৪১৮ জন শিক্ষার্থী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। তিনি আরো বলেন, এছাড়াও আমাদের ৪১৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৪টি শ্রেণিকক্ষ তাও ঝুঁকিপূর্ণ সব মিলিয়ে একটি মুসিবতের মধ্যে আছি। এই কোমলমতি শিশুদের জীবন ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ছায়েদুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়টির পুরাতন ভবনের কোল ঘেঁষে নির্মাণের কাজ শুরু হলে মামলা জটিলতায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে পুরাতন ভবনের দুইটি শ্রেণিকক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেতে অবিলম্বে মামলা নিষ্পত্তি পূর্ব কাজ চলমান হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পিডি স্যারসহ স্কুল পরিদর্শন করেছেন আশা করছি দ্রুত সমাধান হবে। মামলার বাদী মোতালেবের কাছে ফোনে তার মামলা করার কারণ ও স্কুলের জায়গার বিরোধের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখন অসুস্থ, পরে কথা বলবো। এই বলে ফোন কেটে দেন।
Leave a Reply