দখিনের খবর ডেস্ক ॥ প্রশাসনের কেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরেই স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, তার অন্তত ৭টি সচিবালয়ে মানতে দেখা যায়নি। তবে মাস্ক পরাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত সতর্কতা ছিল।
গতকাল রোববার প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক সচিবালয় ঘুরে দেখেছেন এসব চিত্র। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শৌচাগারগুলোতে সাবান ছিল না। এই অবস্থা স্বাস্থ্য ছাড়াও আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দেখা গেছে। কিছু শৌচাগারে তরল সাবান রাখার বক্স থাকলেও সেগুলো ছিল ফাঁকা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার রোধে ৬৬ দিন ছুটি থাকার পর গতকাল সচিবালয়সহ সব অফিস খুলেছে। জরুরি কাজের জন্য কয়েকটি মন্ত্রণালয় আগেই খোলা ছিল। গতকাল খুলেছে সব কটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। তবে সচিবালয়ে সাধারণ দর্শনার্থী প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি।
সরেজমিন স্বাস্থ্যবিধি মানতে ঢিলেঢালা চিত্র দেখা যায়। মূল প্রবেশপথে জীবাণুমুক্তকরণ টানেল বসানো হয়নি। হ্যান্ড থার্মাল স্ক্যানারে প্রবেশকারীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছিল। তবে কেউ কেউ তাপমাত্রা না মেপেও ঢুকেছেন। সচিবালয়ে লিফটগুলোতে সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে অফিসে প্রবেশ করাতে হবে। একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ঢোকার সময় তাঁদের শরীরের তাপমাত্রা দেখা হয়নি।
কর্মস্থলে প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর জীবাণুমুক্ত করা এবং ঘন ঘন সাবান–পানি বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ২ নম্বর ভবনের নিচতলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ৩ নম্বর ভবনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাতটি শৌচাগারে সাবান ছিল না।
খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি তলার তিনটি শৌচাগার ঘুরেও সাবান বা তরল জীবাণুনাশক পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের কক্ষের পাশে অবস্থিত শৌচাগারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সাবান নেই। একটি তরল সাবান রাখার বক্স থাকলেও তা ফাঁকা। একই চিত্র ওপরের তলার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের কক্ষের পাশের শৌচাগারে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব (প্রশাসন-১) খন্দকার জাকির হোসেন বলেন, ব্যক্তিগত টয়লেটগুলোতে সাবান আছে। বাইরের শৌচাগারগুলোতে সাবান দিলে তা কে বা কারা নিয়ে যায়। তারপরও শৌচাগারগুলোতে সাবানের ব্যবস্থা করা হবে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের কাছে সাবান থাকে বলে জানান তিনি।
সচিবালয়ের ৬ ও ৭ নম্বর ভবনের নিচতলায় লিফটের সামনে নোটিশ লেখা ‘ভবনে প্রবেশের পূর্বে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন’। নোটিশের পাশে একটা ঝুড়ি থাকলেও তাতে স্যানিটাইজার নেই। অন্য ভবনগুলোতেও নির্দিষ্ট কোথাও স্যানিটাইজার রাখতে দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, সচিবালয়ের ভেতরে সংক্রমণ ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিজ উদ্যোগে মাস্ক পরা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই জোরালো না। একেক কক্ষে চার-পাঁচজন করে বসায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, ধর্ম ও যুব মন্ত্রণালয় ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসতে গেলে সবার জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। সে জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছি।’
গত ২৮ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে শর্তসাপেক্ষে কার্যাবলি পরিচালনার প্রজ্ঞাপন জারি করে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নিজস্ব পরিদর্শন দলের মাধ্যমে তদারক করা হবে। চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কথা বলে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত পরিদর্শন দল গঠন করা হয়নি।
দৃশ্যমান জায়গায় ছবিসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা ঝুলিয়ে রাখার নিদেশ দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সচিবালয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংবলিত এমন নির্দেশনা দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ব্রিফিং হয়নি। তবে অনেক কর্মকর্তার কক্ষের দরজায় ‘করোনাভাইরাস ইস্যু: জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’ লেখা নোটিশ টানানো দেখা যায়।
অফিসের যানবাহনে বসার সময় কমপক্ষে তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। যাত্রার আগে ও যাত্রাকালীন পথে বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিকেল সোয়া চারটার দিকে মূল ফটকের বাইরে দেখা যায়, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একটি স্টাফ বাসে কর্মচারীরা উঠছেন। ওই বাসের এক যাত্রী বলেন, অতিরিক্ত বাস বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই গাদাগাদি করেই যাতায়াত করতে হচ্ছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মচারী বলেন, তিনি যে স্টাফ বাসে এসেছেন সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
সরকার গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ১৩টি স্বাস্থ্যবিধির প্রতিটিই সঠিকভাবে মানতে হবে। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধির একটিও অমান্য হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।
অফিস খোলার প্রথম দিনে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এসেছেন প্রায় সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। দপ্তরগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল অর্ধেকের বেশি। সচিবালয়ে অফিস করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণি, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ অধিকাংশ মন্ত্রী-সচিব।
Leave a Reply