করোনার ঝাপ্টায় দেশের সব মানুষ মরে যাবে না। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে না। একদিন না একদিন টিকা বা ভ্যাকসিনসহ করোনার চিকিৎসা আবিষ্কার হবে। বাংলাদেশও এ অভিযাত্রায় পিছিয়ে থাকবে না- নিশ্চিত বলা যায়। সেই চেষ্টা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। একটু-আধটু সাফল্যও আসছে।
করোনার আগে অ্যানথ্রাকস, সার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জিকা, নিপাসহ জটিল-কঠিন নানা বিমারী দুনিয়া তছনছ করেছে। বহু মানুষের প্রাণহানি করেছে। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও করোনার চিকিৎসা নিয়ে চটজলদি ভাবতে বাধ্য হয়েছে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোও। সেটা উকুন-বিড়াল মারার ওষুধ দিয়ে হোক আর মুফতি ইব্রাহিমের কোডিং দিয়ে হোক। গোবিষ্ঠা বা গোমূত্র থেরাপি দিয়ে হলেও। বৈশ্বিক মহামারী করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার তুলনা চলে না।
করোনার ভয়াবহতা বড় করুণাহীন। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম দেখা দেওয়া এ ভাইরাসটির বিস্তার প্রায় গোটা দুনিয়াতেই। নির্জলা সত্য হচ্ছে, গত পাঁচ-ছয় মাসেও এখন পর্যন্ত কেউ এর কোনো প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেনি। তবে রাতদিন একযোগে কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও অনুজীব বিজ্ঞানীরা। প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মধ্যে। এই রেসে বাংলাদেশও। কবে নাগাদ এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে, কেউ বলতে না পারলেও আশাবাদ বিভিন্ন মহলে।
প্রতি শতাব্দীতে বিভিন্ন ঘাতক ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে বছরের পর বছর লেগেছিল। মানুষ মরেছে, বিকলাঙ্গ হয়েছে। চিকিৎসা আবিষ্কারের অপেক্ষাও করেছে। জিকা ভাইরাস প্রথম পাওয়া যায় ১৯৪৭ সালে উগান্ডায় রেসাস ম্যাকাক বানরের দেহে। পরে ১৯৫২ সালে এর অবস্থান শনাক্ত হয় উগান্ডা ও তানজানিয়ায় মানবদেহে। উগান্ডার জিকা নামের একটি গ্রামের নাম অনুসারে এ ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। স্থানীয় ভাষায় জিকা মানে বাড়ন্ত। ৭৩ বছর গড়িয়ে গেলেও আজতক জিকার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
অতিমাত্রার সংক্রামক ব্যাধি চিকেন পক্স শনাক্ত হয় ১৯৫৩ সালে। গুটিবসন্ত নামে পরিচিত অসুখ সারানোর টিকা আবিষ্কার হয় ৪২ বছর পর ১৯৯৫ সালে। তা আবিষ্কারে জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করেছেন এডওয়ার্ড জেনার। তার মালির আট বছরের পুত্র জেমস ফিপসের শরীরে প্রয়োগের মাধ্যমেই পৃথিবী জানতে পারে চিকেন পক্সের টিকার কার্যকারিতার কথা। লিভার নিঃশেষ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা ভাইরাস হেপাটাইটিস বি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। ১৬ বছর পর ১৯৮১ সালে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন পাবলো ডি ভ্যালেনজুয়েলা।
ইবোলা নামের ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৬ সালে। এর ভ্যাকসিন তৈরি করতে বিজ্ঞানীদের সময় লাগে ৪৩ বছর। ২০১৯ সালে জনসন অ্যান্ড জনসন তার জনসন ফার্মাসিউটিক কোম্পানিতে ইবোলা ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। ভয়ঙ্কর ঘাতক এইডসের বাহক এইচআইভি ভাইরাস প্রথম ১৯৮১ সালে শনাক্ত হয় আফ্রিকায়। প্রায় ৪০ বছর ধরে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাধনা চলছে। করোনার মতো সার্স ভাইরাসের জন্মও চীনে ২০০৩ সালে। ১৭ বছর পর এখনো এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার গবেষণারত। মার্স ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০১২ সালে সৌদি আরবে। আট বছর ধরে এর ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত আক্রমণ করা ভাইরাসগুলোর মধ্যে করোনাকেই সবচেয়ে মারাত্মক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনো রোগ সুবিশাল ভৌগোলিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাকে প্যানডেমিক বলা হয়। গ্রিক শব্দ প্যানের অর্থ সবাই এবং ডেমোস মানে মানুষ। করোনা ভাইরাস শব্দটি লাতিন থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ মুকুট। কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে প্রাথমিকভাবে ২০১৯-এনকভ নামে ডাকার সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে এটি কোন সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল অর্থাৎ ২০১৯ এবং ‘এন’ দিয়ে নোভেল বা নিউ বা নতুন বোঝায় এবং ‘কভ’ দিয়ে বোঝায় করোনা ভাইরাস। তবে এটি বাজারে টেকেনি। প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে করোনা নামে। সাধারণত সদ্য গজানো কোনো ভাইরাসের নামকরণ কিছুটা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু করোনা নামকরণে সময় লাগেনি। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানবদেহে যে রোগটি হয় তার নাম কোভিড-নাইনটিন।
যে কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার বেশ জটিল কাজ। সাধারণত এর জন্য অনেক সময় ও অর্থ দরকার হয়। ভয়াবহতা বিচারে করোনার প্রতিষেধক বেশি কঠিন হলেও তত সময় লাগবে না বলে আশা জাগছে ভাবনমুনায়। ভাইরাসটি চিহ্নিত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা ছড়ানো বন্ধের জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণা শুরু হয়। বৈশ্বিক ভ্যাকসিন বা টিকা শিল্পে নামকরা প্রতিষ্ঠান পিফিজার, মার্ক, গ্লাক্সোস্মিথ, স্যানোফি, জনসন অ্যান্ড জনসন ইত্যাদির সঙ্গে ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানও যোগ হয়েছে। এটি লক্ষণ হিসেবে আশাজাগানিয়া। আগামী ১৫ আগস্ট, দেশের স্বাধীনতা দিবসেই প্রতিবেশী ভারতের বিজ্ঞানীদের তৈরি করোনার প্রতিষেধকটি সর্বস্তরে চালু করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ’ (আইসিএমআর)। কিন্তু এর পরই কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানমন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্পষ্ট জানিয়ে দেন ২০২১ সালের আগে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য করোনা প্রতিষেধক বাজারে ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে যা-ই হোক, তারা প্রতিষেধক আবিষ্কারে সচেষ্ট, সেই বার্তা পরিষ্কার।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও আগুয়ান এ চেষ্টায়। আশার বাণীও শোনাতে শুরু করেছেন। শুধু স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশাও দেখাচ্ছেন। নিজস্ব ভ্যাকসিন, নিজস্ব পরীক্ষা কিট এবং নিজস্ব ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে করোনা মহামারী জয়ের ব্যাপারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. বিজন কুমার শীল, ড. সেঁজুতি কুমার সাহা, ড. আসিফ মাহমুদদের জন্য শুভ কামনা করছেন পুরো দেশবাসী। করোনা মোকাবিলায় বিদেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বাংলাদেশও যে কিছু করতে পারে, সেই স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন চেষ্টার বিশ্বাস তারা জাগিয়েছেন। সারাবিশ্ব পারলে আমরা পারব না কেন? স্বপ্নভরা এ প্রশ্ন তারা দেখাতে পেরেছেন।
গরিব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর হলেও এখানে মেধাবী মানুষও আছেন, আমাদের সামনে এ উদাহরণ তো আছেই। এর আগে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড. বিজন। পরে এটি চীন কিনে নিয়ে যায়। গবেষক ড. সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে আমাদের চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন দেশে সর্বপ্রথম করোনার জিনোম সিকোয়েন্স (জীবন রহস্য) উদ্ঘাটন করে। আমাদের দুটি ওষুধ কোম্পানি করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বে স্বীকৃত দুটি কার্যকরী ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। বাংলাদেশই কলেরা মহামারী নিয়ন্ত্রণের পথ দেখিয়েছে বিশ্বকে। লবণ আর গুড় দিয়ে খাবার স্যালাইন আবিষ্কার ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) অবদান। বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রির বিজ্ঞানীরাই তো নিত্যনতুন ধান উৎপাদন করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। এ পর্যন্ত তারা আউশ ও আমন ধানের ১০২টি জাত উদ্ভাবন করেছেন।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কার দেশে মাছের ঘাটতি পূরণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটা সফটের এক দল উদ্যমী গবেষক ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জীবনরহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ঘাটন করেছেন। ড. মোবারক আহমেদ খানের পাট দিয়ে ঢেউটিনসহ নানা পণ্য উদ্ভাবনে তোলপাড় তৈরি করেছে। ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বিশ্বে পথপ্রদর্শক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছেন। বিদেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দাপটের সঙ্গে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন নাসা, গুগল, মাইক্রোসফট, ইন্টেল, ফেসবুক ইত্যাদি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে। এরও বহু আগে বিজ্ঞানী ড. কুদরাত ই খুদা পাটকাঠি থেকে ম- করে বোর্ড তৈরি করেছেন। বাংলাদেশি স্থপতি ড. এফআর খান আমেরিকার শিকাগোর ১০৪ তলাবিশিষ্ট সিয়ার্স টাওয়ারের (বর্তমান নাম উইওলস টাওয়ার) নকশা করে জগৎখ্যাতি পেয়েছেন। সেই বাংলাদেশ কেন একটি সুন্দর সকালের প্রতীক্ষায় থাকবে না?
করোনা ভাইরাসের ওছিলায় পড়াশোনা না জানা বা কম জানা বাঙালিও বহু দাঁতভাঙা ইংরেজি শিখেছে। কোভিড-নাইনটিন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, ইনকিউবেশন, মিউট্যান্ট, পিকটাইম, জার্মিনেশন, পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট-পিপিই, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, কমিউনিটি ট্র্যান্সমিট, ভেন্টিলেশন আরও কত কী? ‘আইইডিসিআর’ নামে বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান রয়েছে- সেটাই বা কজন জানতেন। এখন জানেন। বোঝেন। একদিন করোনার কোনো টিকা বা ভ্যাকসিনের কঠিন নামও জেনে যাবে। সেটারই এখন অপেক্ষা।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
Leave a Reply