নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প (বিসিক) উন্নয়নকল্পে চরম অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। রাস্তা, কালভার্ট ও স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিত্যক্ত ইটসহ নি¤œমানের সামগ্রী। এনিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের মাঝে অসন্তোস চরম আকারে ধারণ করলে প্রভাবশালী একটি মহল তাদেরকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। বিশেষ করে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় বিদ্রোহী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে শিল্পনগরী ছাড়া করাসহ মামলায় জড়িয়ে হয়রানির হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টিতে বিসিক কর্তৃপক্ষ অবগত থাকলেও রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ থাকা নিয়ে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারও কারও অভিমত কাজে অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খোদ মালিক সমিতির শীর্ষ নেতাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি বিষয়টি বিসিক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেও সুফল মেলেনি। বরং প্রকল্প উন্নয়নের নামে চলছে এক ধরণের লুটপাট। সেই লুটপাটে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অংশও ভাগ বসিয়েছে। নি¤œমানের উন্নয়ন কাজ হচ্ছে দাবি করে ইতিমধ্যে হাতিয়েছে অর্ধকোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিসিক নগরী উন্নয়নে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৭৬ কোটি টাকা শিল্প মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়ে গত বছরের মার্চ মাসে নির্মাণ কাজ শুরুর নির্দেশনা দেয়। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে যথাসময়ে কাজ শুরু করতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটির একজন দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কাজপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনুস এন্ড বাদ্রার্স প্রাইভেট লিমিটেড, মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, এমএস বিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং মেসার্স ইসলাম ব্রাদার্সকে ওয়ার্ক অর্ডার গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের শুরুর দিকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ ও করোনা মহামারি আকার রুপ নেওয়ায় এখানেও বাধা আসে। একপর্যায়ে সকল বাধা উপেক্ষা করে চলতি বছরের মে মাসে ওই চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। যার মধ্যে রয়েছে- বিসিক নগরীর তিন কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ, ভূমি উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর, ড্রেন-কালভার্ট নির্মাণ, প্রধান ফটক ও পুকুর সংষ্কার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নামকাস্তে থাকলেও পুরো উন্নয়ন কাজ বিসিক শিল্প মালিক সমিতি নেতারাই করছেন। অবশ্য এই বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা খাইরুল বাশার নিজেও এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন।
একাধিক প্রতিষ্ঠান মালিক অভিযোগ করেন, বিসিক উন্নয়নকল্পে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ৩৫ বছর আগের অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে নির্মিত সড়কের পুরাতন ইট তুলে সেগুলো ভেঙে নতুন রাস্তাসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি প্রতিবাদী হয়ে উঠলে হেনস্তার শিকার হন। এমনকি বিসিক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেও কোনো সুফল মেলেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে অধিকাংশ মালিকসহ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের মাঝে অসন্তোস বিরাজ করলেও ভয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার সাহস দেখাচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেই পুরাতন কাঁদামাটিযুক্ত ইট ভেঙে নতুন রাস্তায় ব্যবহার করছে শ্রমিকেরা। এ বিষয়ে জানতে বিসিক নগরীর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. অহিদুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি যা বললেন তা বড়ই বিস্ময়ের। তার ভাষায় একাধিকবার অনিয়ম বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ক্ষমতাধর মালিক সমিতি শোনেনি। তবে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৌশলী নিজেই শিল্প মালিকদের সাথে একজোট হয়েছেন, দিয়েছেন পুরাতন ইট ব্যবহারের নির্দেশ।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, উন্নয়ন কাজের এই অনিয়ম-দুর্নীতির খবরাখবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে চলে যাওয়ার পর তারা বরাদ্দের অংশে ভাগ বসিয়েছে। শীর্ষ এক নেতার পক্ষে বিসিকের এই প্রকল্প থেকে ৫ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে অর্ধকোটি টাকা নিয়ে কাজ করার সমর্থন দিয়েছে। তবে টাকা ভাগাভাগি ও উন্নয়ন কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করলেন শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও ফরচুন সু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান।
অনিয়ম-দুর্নীতির উন্নয়নকল্প কতটা টেকসই হবে বা ব্যবসায়ীরা সুফল পাবে এমন প্রশ্নে জর্জড়িত বিসিক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সেখানকার শীর্ষ কর্মকর্তা জালিস মাহমুদের বক্তব্য, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করছেন এখানকার প্রকল্প কর্মকর্তা খাইরুল বাশার। সঙ্গত কারণে এ বিষয়ে তিনি সঠিক ব্যাখা দিতে পারবেন।’ অনুরুপ বিষয়ে জানতে খাইরুল বাশারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কাজের শুরুতে কিছুটা অনিয়ম হয়ে থাকে। কিন্তু এখন ওয়ার্ক অর্ডারের নির্দেশনা মেনে বাস্তবায়ন চলছে। তবে নতুন করে পুরাতন ইট ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠলো তা খতিয়ে দেখা হবে।’ এদিকে বিসিকের অপর একটি সূত্র জানায়, বিসিক কর্মকর্তা খাইরুল বাশারকে প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে পটুয়াখালীতে বদলির আদেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। খুব শীঘ্রই তার সেখানে যোগদানের কথা থাকলেও বরিশাল বিসিক উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়াদি শীর্ষ কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করছেন। ফলে বোঝার অপেক্ষা রাখে না যে কি রকমের লুটপাট চলছে।
Leave a Reply