শ্যাং জিন ওয়েই:
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে চীনা ভিডিও অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করার পর টিকটকের মূল কোম্পানি বাইটড্যান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক পরিচালনা করা মার্কিন কোম্পানি মাইক্রোসফটের মধ্যে তুমুল অস্থিরতা চলছে।
ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, টিকটক জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ কারণে টিকটকের পেরেন্ট কোম্পানি বাইটড্যান্সের সঙ্গে লেনদেন করা যাবে না। ৪৫ দিন পর এই নির্দেশ কার্যকর হবে। আলাদা আরেকটি নির্বাহী আদেশে চীনের আরেকটি জনপ্রিয় অ্যাপ উই চ্যাটের পেরেন্ট কোম্পানি টেনসেন্টের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখা যাবে না বলে বলা হয়েছে।
এই আদেশ ৪৫ দিন পর চালু হবে, তাই এর মধ্যে বাইটড্যান্স চাইলে টিকটক অ্যাপটি মাইক্রোসফটের কাছে বেচে দিতে পারবে। টিকটক কিনে নেওয়ার জন্য বাইটড্যান্সের সঙ্গে মাইক্রোসফট আলোচনা করছে। তবে যতটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে বাইটড্যান্স রাজি হবে বলে মনে হয় না। ৪৫ দিনের মধ্যে মাইক্রোসফট যদি কিনতে পারে তো ভালো, না হলে টিকটক যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। টিকটকের মতো উই চ্যাটও আমেরিকায় জনপ্রিয়। সেটিও বন্ধ হবে। এটা ঠিক যে টিকটককে ‘পানির দামে’ কিনে নেওয়ার জন্য ট্রাম্প এই নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন। এর সঙ্গে নানা বিষয় জড়িয়ে আছে। অবশ্য ট্রাম্প বলেছেন, টিকটক কেনার সময় মার্কিন ক্রেতা (মাইক্রোসফট) যেন ‘অতি আমেরিকান’ হয়, অর্থাৎ দস্তুরমতো দর-কষাকষি করে তা কেনে। ট্রাম্প আকারে–ইঙ্গিতে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, এই নিষিদ্ধের হুমকি দেওয়ায় অনেক কম দামে বাইটড্যান্স তাদের টিকটক বেচতে বাধ্য হবে এবং যেহেতু সরকারের আদেশের কারণে মাইক্রোসফট সেটি কিনতে পারবে, সেহেতু মাইক্রোসফটকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের ‘ফি’ সরকারের ঘরে জমা দিতে হবে।
যদিও এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প দৃশ্যত স্বল্পমেয়াদি একটা ফায়দা তুলতে পারবেন, কিন্তু এতে বিদেশের মাটিতে থাকা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে তিনি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। বাইটড্যান্স প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। ২৯ বছর বয়সী ঝ্যাং ইয়াইমিং ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, টেলসার এলোন মাস্ক, আমাজনের জেফ বেজোস, অ্যাপলের স্টিভ জবসের মতোই প্রভাবশালী একজন উদ্যোক্তা। বাইটড্যান্সের আওতায় অনেকগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোডাক্ট হলো টিকটক। ১৪০টির বেশি দেশে এই অ্যাপ তুমুল জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও খুব সহজেই সম্পাদনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা যায়। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিশ্বে সর্বাধিক ডাউনলোড করা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ হলো এটি।
যেহেতু টিকটক একটি চীনা ডিজিটাল পণ্য, সেহেতু এর মাধ্যমে তথ্য পাচার হওয়ার ঝুঁকি আছে—এই বিবেচনায় বাইটড্যান্স যুক্তরাষ্ট্রে সচল থাকা টিকটককে বাউটড্যান্স থেকে যথাসম্ভব বিযুক্ত রেখেছে। এ বিষয়ে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্য অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে একটি হলো, তারা যুক্তরাষ্ট্রের টিকটক ব্যবহারকারীদের তথ্য–উপাত্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সার্ভারে জমা রেখেছে, যদিও সেসব তথ্য–উপাত্তের একটি ব্যাকআপ কপি সিঙ্গাপুরেও জমা হয়ে থাকে। টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওয়াল্ট ডিজনির সাবেক নির্বাহী কেভিন মায়ারকে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এগুলো যথেষ্ট নয়। তাদের কথা হলো, এই টিকটকের মাধ্যমে চীন মার্কিনদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র এখনো কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, টিকটককে কম দামে ‘অতি আমেরিকান’ ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হলে চীনে সক্রিয় থাকা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। আমেরিকায় চীনের যে পরিমাণ বিনিয়োগ আছে, তার চেয়ে আমেরিকার অনেক বেশি অর্থ চীনে বিনিয়োগ করা আছে। শুধু ২০১৯ সালেই চীনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে চীনের কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করেছে ৬০০ কোটি ডলার।
এর বাইরে জেনারেল মোটরস, জেনারেল ইলেকট্রিক, ডিউপয়েন্ট, মেরেক, ফাইজার, এলি লিলি, ব্রিস্টল মায়ার্স স্কুইব, বোয়িং, নাইকি, কোকা–কোলা, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, মাইক্রোসফট, স্টারবাকস, কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডসের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলো চিনের মাটিতে ব্যবসা করছে।
ট্রাম্প টিকটক নিয়ে যে পদক্ষেপ নিলেন, ঠিক একই ধরনের ব্যবস্থা যদি চীন নেয় এবং এসব ব্যবসাকে কম দামে ‘অতি চৈনিক’ ব্যবসায়ীদের কাছে বেচতে বাধ্য করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের চাপে পড়বে, তা অনুমেয়।একমাত্র ট্রাম্প চাইলেই তাঁর টিকটক নিষিদ্ধের নীতি থেকে সরে আসতে পারেন। ৪৫ দিনের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়ে আসছে। ঘড়ির কাঁটা বলছে টিক টক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শ্যাং জিন ওয়েই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক
Leave a Reply