আমতলী প্রতিনিধি ॥ মোটা অংকের অংর্থের বিনিময়ে গায়েরী লোহার সেতুর প্রাক্কলন দেখিয়ে লোহার সেতু মেরামতের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। আর এ দরপত্র আহবান করেছেন বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফোরকান আহম্মেদ খানের বিরুদ্ধে। খাল নেই, সেতুও নেই, রয়েছে বাঁশের সাঁকো। আমতলীর ওই বাঁশের সাঁকোকে লোহার সেতু দেখিয়ে মেরামতের প্রাক্কলন তৈরি করে দরপত্র আহবান করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। ওই দরপত্র বাতিলপূর্বক সরেজমিনে সার্ভে করে পুনরায় প্রাক্কলন তৈরির দাবী জানিয়েছেন ঠিকাদাররা। এ সকল গায়েরী সেতুর খবরে এলাকার মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বরগুনা এবং আমতলীর ঠিকাদাররা সংবাদ সম্মেলন এবং মানব বন্ধন করে ওই দরপত্র বাতিলের দাবীর পর বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী ২৭ আগস্ট এলজিইডির প্রধান প্রকেীলীকে দরপত্র বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছেন। জানাগেছে, বরগুনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০২০-২১ অর্থ বছরে আইবিআরপি প্রকল্পের আওতায় ওটিএম পদ্ধতিতে গত ২৮ জুলাই ৮ টি প্যাকেজে ৩৩টি লোহার সেতু মেরামতের জন্য দরপত্র আহবান করে। যার প্রাক্কলন ব্যয় দরপত্রে উল্লেখ নেই।
আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ওই দরপত্রে অংশ গ্রহনের শেষ দিন। ওই দরপত্র নোটিশ প্রকাশিত হওয়ার পর বেড়িয়ে আসে অনিয়মের আসল চিত্র। ৩৩ টি সেতুর মধ্যে ২৫ টি আমতলী উপজেলার হলদিয়া, গুলিশাখালী ও আমতলী সদর ইউনিয়নে এবং ৮ টি সেতু তালতলী উপজেলায়। ওই দরপত্রের নোটিশে উল্লেখ আছে আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের বাঁশবুনিয়া খালের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় সামনে লোহার সেতু। অপর দিকে একই স্কুলের সামনে একই সেতু নাশবুনিয়া খালে দেখানো হয়েছে। দৃশ্যত নাশবুনিয়া নামে কোন খাল নেই। দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামের শেলিম খান ও আবদুল গনি গাজী বলেন, নাশবুনিয়া নামে হলদিয়া ইউনিয়নে কোন খাল নেই। একই ইউনিয়নের তুজির বাজার ও রামজির বাজারে নামক স্থানে দুইটি সেতু মেরামতের কথা উল্লেখ রয়েছে ওই নোটিশে। কিন্তু তুজির বাজার ও রামজির বাজারের সামনের হলদিয়া খালে কোন সেতু নেই। ওই দুই বাজারের খালে রয়েছে বাঁশের সাঁকো। এলাহিয়া দাখিল মাদ্রাসার সামনে এবং দক্ষিণ রাওঘা কেরাতুল কোরান মাদ্রাসার সামনে সেতু মেরামত দেখানো হয়েছে কিন্তু ওই দুই মাদ্রাসার সামনের খালে কোন সেতু নেই।
ওখানেও রয়েছে বাঁশের সাঁকো। বাঁশের সাঁকো দিয়ে বর্তমানে মানুষ পারাপার হচ্ছে। বিশ^স্থ একটি সুত্রে জানাগেছে, তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হলদিয়া ইউনিয়নে ছয়টি সেতুর দরপত্র আহবান করেছিল। কিন্তু ঠিকাদার একটি সেতু নির্মাণ করে বাকী পাঁচটি সেতু নির্মাণ না করে এলজিইডির কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে কাগজে কলমে নির্মাণ দেখিয়ে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বর্তমানে ওই সেতু ছয়টির নামে মেরামত দেখিয়ে দরপত্র আহবান করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
আমতলী হলদিয়া ইউনিয়নের রামজির বাজারের ইদ্রিস হাওলাদার, তুজির বাজারের রাজ্জাক মোল্লা মতি মৃধা বলেন, জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত তুজির বাজার ও রামজির বাজারে কোন সেতু দেখি নাই। এখন শুনছি ওই খানে ১২ বছর আগে সেতু হয়েছিল। তাহলে সেতুগুলো গেল কোথায়? এমন অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তি দাবী করছি। একই চিত্র গুলিশাখালী ও আমতলী সদর ইউনিয়নে। গুলিশাখালী ইউনিয়নের একই সড়কে ৬টি সেতু মেরামত দেখানো হয়েছে। যার কোন ভিত্তি নেই এ কথা বলেন এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে বরগুনা নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিইডি) ফোরকান আহম্মেদ খান মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ওই ৩৩টি ব্রীজ এলাকা সরেজমিনে সার্ভে না করেই প্রভাবশালী ঠিকাদারের লোকজন দিয়ে গায়েরী ব্রীজের পুঃনস্থাপনের প্রাক্কলন তৈরি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এছাড়া ওই ৩৩ টি ব্রীজের পুঃনস্থাপন প্রাক্কলন তৈরিতে রয়েছে নানাবিধ অনিয়ম। প্রাক্কলনে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের চেয়ে দ্বিগুন অর্থ বরাদ্দ দেয়া, জনস্বার্থে বীজ নির্মাণ না করা, ব্রীজের অ্যাপ্রোচ সড়কে প্রয়োজনের তুলনায় চারগুন অর্থ বরাদ্দ দেয়া ও পুরাতন ব্রীজের ব্যবহারযোগ্য মালামাল স্যালভেজ হিসেবে অন্তর্ভক্ত না করা।
ওই প্রাক্কলনে প্রত্যেকটি ব্রীজের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা বেশী দেখিয়ে প্রাক্কলনে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়ের চেয়ে দ্বিগুন অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন, যাতে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের অর্থ আত্মসাতে সুবিধা হয় এমন অভিযোগ করেন সাধারণ ঠিকাদার গাজী ফারুক আহম্মেদ। এদিকে সাধারণ ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান না করে ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করেছেন বরগুনা নির্বাহী প্রকৌশলী। ওটিএম পদ্ধতিতে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন এতে সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্রে অংশগ্রহনের সুযোগ নেই বলে দাবী করেন তারা। তারা আরো অভিযোগ করেন, দরপত্রের নোটিশে প্রাক্কলন ব্যয় উল্লেখ নেই। ওই প্রাক্কলনের ব্যয় একমাত্র নির্বাহী প্রকৌশলী নিজেই জানেন। নোটিশে প্রাক্কলন ব্যয় উল্লেখ না থাকায় কমিশনে সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্রে অংশগ্রহন করতে পারবে না। এছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি কাজের জন্য একটি প্যাকেজ তৈরির নিয়ম থাকলেও নির্বাহী প্রকৌশলী ওই প্রকল্পের ৩৩টি কাজকে ৮ টি প্যাকেজ করে দরপত্র আহবান করেছেন যা নিয়ম বর্হিভুত। বরগুনা নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহম্মদ খানের এমন অনিয়ম ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন সাধারণ ঠিকাদাররা। তারা ওই সকল গায়েরী ব্রীজ পুঃনস্থাপনের দরপত্র বাতিল ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছে। এদিকে ওই সকল গায়েরী ব্রীজের খবরে এলাকার মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এমন অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবী করেছেন।
মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘুরে দেখাগেছে, তুজির বাজার, রামজির বাজার, এলাহিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও কেরাতুল কোরান মাদ্রাসার সামনে কোন সেতু নেই। ওই চারটি স্থানে রয়েছে দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো। ওই বাঁশের সাকো দিয়ে মানুষ পারাপার হচ্ছে। হলদিয়া ইউনিয়নে নাশবাড়িয়া খালে যে সেতু দেখানো হয়েছে ওই নামে কোন খাল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে এই গায়েবি সেতুর দরপত্র বাতিলের দাবীতে বরগুনা ও আমতলীর সাধারন মানুষ ফুসে ওঠার পর গত ২৭ আগস্ট বরগুনার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফোরকান আহম্মেদ আহবান করা দরপত্র বাতিলের জন্য এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর নিকট একটি চিঠি দিয়েছেন বলে বরগুনা কার্যালয়ের গোপনীয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে আমতলী ঠিকাদার সমিতির সভাপতি জিএম ওসামানী হাসান বলেন, বরগুনা স্থানীয় সরকার নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহম্মেদ খান মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের যোগসাজসে ৩৩টি সেতু সংস্কারের প্রাক্কলন তৈরি করেছেন। যার কোন ভিত্তি নেই। ওই ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। ওই শর্তানুসাারে সাধারণ ঠিকাদার দরপত্রে অংশগ্রহন করার কোন সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমতলী উপজেলায় অন্তত ৫৫ টি লেঅহার সেতুর দরপত্র হয়েছিল। ওই সেতুগুলোর মধ্যে অধিকাংশ সেতু নির্মাণ না করেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এখন আবার ওই সেতুগুলো সংস্কার দেখিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করে দরপত্র আহবান করেছেন। ওই ৩৩টি সেতুর দরপত্র বাতিল পূর্বক পুনরায় সরেজমিনে সার্ভে করে প্রাক্কলন তৈরির আহবান জানান তিনি। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বরগুনা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফোরকান আহম্মেদ খানের মোবাইল ফোনে (০১৭০৮১২৩১৮৩) একাধিকবার ফোন এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার কোস জবাব পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার অফিসের এবং বাসার সরকারী ল্যান্ড ফোনে (০৪৪৮-৬২৫৩১, ০৪৪৮-৬২৫৪২) ফোন করলেও রিসিভ করেননি।
Leave a Reply