বরগুনা সংবাদদাতা ॥ বরগুনার আলোচিত শাহনেওয়াজ রিফাত (রিফাত শরীফ) হত্যা মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের রায় দিয়েছেন আদালত। ছয় জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন বিচারক। এই আসামিদের কয়েকজনসহ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পরিকল্পনায় গঠন করা হয়েছিল ‘বন্ড ০০৭’ নামের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ। হত্যাকা-ের পর ‘বন্ড-০০৭’ গ্রুপ ছেড়ে এর সদস্যরা ‘টিম ৬১’, ‘লারেলাপ্পা’ ও ‘হানিবন্ড’সহ বেশ কিছু গ্রুপে সক্রিয় থেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছিল। এই বন্ড গ্রুপের সদস্যদের বেশিরভাগই ছিল কিশোর। তারা ও তাদের সহযোগীরা এখন বিভিন্ন অপরাধ তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে। তাই কিশোর গ্রুপগুলোর ওপর নজরদারি বৃদ্ধির দাবি বরগুনার সচেতন মহলের।
খোঁজ নিযে জানা গেছে, রিফাত হত্যাকা-ের পর দিন থেকে নিস্ক্রিয় হতে থাকে বন্ড-০০৭ গ্রুপ। হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি ও বন্ড-০০৭ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে পুরোপুরি নিস্ক্রিয় হয়ে যায় বন্ড-০০৭ গ্রুপটি। অনেকেই গ্রুপ থেকে লিভ নিয়ে নেয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, এই গ্রুপের সব মেম্বার তাদের ইচ্ছায় এই সেখানে যুক্ত হয়নি। কিছু কিছু মেম্বারকে নয়ন বন্ড জোর করে এই গ্রুপের মেম্বার করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রিফাত হত্যাকা-ের পর পরই ৬১ জন মেম্বার নিয়ে গঠন করা হয় টিম ৬১ নামের আরেকটি ফেসবুক গ্রুপ। গ্রুপটির প্রথম ধাপে ৬১ জন মেম্বার থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ে। এরপর শুধু বিশ্বস্ত সদস্যদের রেখে বাকিদের রিমুভ করে দেওয়া হয় গ্রুপ থেকে। এই গ্রুপটি থেকে রিফাত হত্যাকা-ের পরের ঘটনা প্রবাহ ও গতিবিধির ওপর নজরদারি করে গ্রুপ সদস্যরা। নয়ন বন্ড ও রিফাত হত্যা নিয়ে গ্রুপ সদস্যদের মধ্যেও একাধিক কথপোকথন হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘টিম-৬১’এর এক সদস্য বলেন, বন্ড গ্রুপটি নিষ্ক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গ্রুপটি তৈরি করা হয়। সেখানে ৬১ জন সদস্যকে যোগ করার কারণে গ্রুপের নামকরণ টিম-৬১ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়।
ওই সদস্য আরও জানান, বন্ড-০০৭ গ্রুপের সদস্য শাহরিয়ার ইমরান, সাদনাম পাপ্পু, আসিফ নাইস সৈকত, আব্দুল্লাহ রিফাত নতুন গ্রুপে সক্রিয় থেকে ঘটনার দিকে নজর রাখে এবং রিফাত হত্যাকা- ও নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে। শুধু ‘টিম৬১’ ই নয়। বরগুনায় আরও সক্রিয় আছে ‘লারেলাপ্পা’ ও ‘হানিবন্ড’ নামের দুটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ। গ্রুপ সদস্য ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘টিম৬১’ গ্রুপটি যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও লারেলাপ্পা গ্রুপটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক সেবনের গোপন গ্রুপ হিসেবে। সেই সঙ্গে হানিবন্ড নামের গ্রুপটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের মাদক সেবনের জন্য। এই গ্রুপের মেম্বার হওয়ার জন্য তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হয় গ্রুপ সদস্যদের। এগুলো হলো- প্রথমত, অবশ্যই তাকে মাদকসেবী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাকে মাদক ব্যবসায় যুক্ত হতে হবে। তৃতীয়ত, এ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাট, অপহরণ ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে অপরাধমূলক কর্মকা-ে অংশ নিতে হবে। এসব গ্যাং সদস্যদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। শুধু হাতেগোনা কয়েকজনের বয়স ৪০-এর মধ্যে। বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘বরগুনায় রিফাত হত্যার অন্যতম কারণ মাদক ও কিশোর গ্যাং। একের পর এক কিশোর গ্যাং মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রশাসনের উচিত এই সব গ্যাংয়ের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে এগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া। না হলে আরও অনেক রিফাত শরীফ অকালে মারা যাবে।’ বরগুনা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘সেই সময় বন্ড ০০৭ মেসেঞ্জার গ্রুপে যারা জড়িত ছিল তাদের উপরও প্রশাসনের উচিত নজরদারি বৃদ্ধি করা। রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের পর এর কিছুটা নিস্ক্রিয় হলেও পরবর্তীতে যে কোনও সময় এরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। যে কোনও সময় যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলী রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়ের দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অপরাধী যে বয়সেরই হোক না কেন সে অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে কিশোর গ্যাং নির্মূলেও জেলা পুলিশ কাজ করছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত করে। এরপর বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে তারা। গুরুতর আহত রিফাত বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই দিনই মারা যান। গত ১ সেপ্টেম্বর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুই ভাগে বিভক্ত অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় পুলিশ। একই সঙ্গে রিফাত হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগে, গত ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। অন্যদিকে ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রিফাত হত্যা মামলায় তার স্ত্রী মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ এবং চার আসামিকে খালাসের রায় দেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক আট আসামি উচ্চ আদালত এবং বরগুনার শিশু আদালতের আদেশে জামিনে রয়েছে।
Leave a Reply