দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ক্রমশই যানজটের নগরীতে পরিণত হচ্ছে বরিশাল মহানগরী। বিশেষ করে শহরের প্রাণ কেন্দ্র সদর রোড, গির্জামহল্লা, ফজলুল হক এভিনিউ, চকবাজার সড়কে সকাল সন্ধ্যা যানজট লেগেই থাকছে। এর মূল কারণ হিসেবে সড়কের পাশে যত্রতত্র গাড়ি পাকিং, অদক্ষ চালক, ফুটপাথ দখল করে অবৈধ দোকানের পসরা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং মাঠ পর্যায়ে ট্রাফিক সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলাকেই দায়ী করেছে বিশেষ মহল। আর এসব কারণেই মহানগরীর সড়কগুলোতে ক্রমশই বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। তাই সড়কে যানজট মুক্ত এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনই ট্রাফিক বিভাগকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।সরেজমিনে দেখাগেছে, ৫৮ বর্গ মাইল বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে মূল শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে সদর রোড, ফজলুল হক এভিনিউ, চকবাজার, গির্জামহল্লা, কাঠপট্টি, লাইন রোড এবং হাসপাতাল রোড এলাকাকে। এসব সড়কের আশপাশ ঘিরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, বিপণীবিতান গড়ে উঠেছে। যে কারণে নগরীর অন্যান্য সড়ক গুলোর তুলনায় উল্লেখিত সড়কগুলোতে মানুষের পদচারণার পাশাপাশি যানবাহনেরও ভিড় বাড়ছে। তার ওপর পথচারীদের চলাচলের ফুটপাথ এমনকি সড়কের পাশের স্থান দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ বাজার। সদর রোড, গির্জা মহল্লা, ফজলুল হক এভিনিউ, চকবাজার, ফলপট্টি, পোর্ট রোড, সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন চত্বর, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে এবং লঞ্চঘাট সড়কের পাশে দিনের পর দিন চলছে ব্যবসা বাণিজ্য।
এর ফলে এক দিকে পোহাতে হয় যানজট, অন্যদিকে ফুটপাথ সংকীর্ণ হয়ে হাঁটা চলার স্থান সংকুচিত হয়ে পরেছে। তাই বাধ্য হয়েই যানজটের মধ্যে হাটতে হয় পথচারীদের। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনাও।
এছাড়া ব্যাটারি চালিত অবৈধ ইজিবাইক (হলুদ অটো), থ্রি-হুইলার অর্থাৎ সিএনজি, মাহেন্দ্র ও গ্যাস চালিত অটো টেম্পু চালকরা যত্রযত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করছেন। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে সংকীর্ণ সড়কের পাশে। এ কারণে সড়কে প্রতিনিয়ত যানজট লেগে থাকছে।
এদিকে, সড়কে যানজট মুক্ত ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেছে।
বিশেষ করে সদর রোডস্থ কাকলীর মোড় ট্রাফিক বক্স, জেলখানার মোড়, নতুন বাজার, বগুরা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে, নথুল্লাবাদ মোড়, ফায়ার সার্ভিস অফিস সংলগ্ন লঞ্চঘাট মোড়, শেবাচিম হাসপাতালের সামনে, আমতলার মোড়, রূপাতলী, চৌমাথা বাজার, বটতলা চৌ রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে যানজট নিরসনের জন্য। কিন্তু উল্লেখিত পয়েন্টগুলোর বেশিরভাগ জায়গায় দায়িত্ব পালনে ট্রাফিক পুলিশের উদাসীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব পয়েন্টে ১২ ঘণ্টাই ট্রাফিক সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তাদের বেশিরভাগ সময় কাটছে চায়ের দোকানে কিংবা পরিচিত জনদের সাথে গল্প গুজবে। আবার শেবাচিম হাসপাতালের সামনে ট্রাফিক সদস্যদের দায়িত্ব পালনের চিত্র আরও করুণ। হাসপাতালের সামনের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটিতে সার্বক্ষণিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে ইজিবাইক (হলুদ অটো), মাহেন্দ্র এবং সিএনজি। পথরোধ করে যাত্রী ওছা নামার কারণে সড়কটি দিয়ে সাধারণ পথচারীদের চলাচল কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন সময় পথচারীদের গায়ে তুলে দেয়া হচ্ছে এসব যানবাহন।
অথচ এ পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তাদের ভূমিকা নীরব দর্শকের মতো। পাশে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব আর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসলে দাঁড়িয়ে স্যালুট বা সম্মান প্রদর্শন ছাড়া তাদের যেন আর কোন দায়িত্ব নেই বলে মন্তব্য করেছেন পথচারীরা।
এদিকে নগরীর গির্জা মহল্লায় অফিস শেষ করে থানা কাউন্সিলের সামনে বাসায় ফেরা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শিফা মাহমুদ যানজটের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অটো, সিএনজি চালকদের কারণে যানজট ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আগে যেখানে গন্তব্যে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট সময় লাগতো এখন সেখানে ১৫-২০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এসব ছোট যানের চালকদের বেশিরভাগই অদক্ষ। যাদের নেই চালক লাইসেন্সও। এরা হুটহাট করেই সড়কের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যাত্রী ওঠা-নামা করছে। এর ফলে পেছনে দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে। আবার নির্ধারিত জায়গার অভাবে সদর রোডের মতো সংকীর্ণ সড়কের পাশে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন পার্কিং করা হচ্ছে।
এর ফলে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠছে। অতিসত্ত্বর যানজট নিরসনের ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বরিশাল শহরের সড়কের অবস্থা আর খারাপের দিকে যাবে। তাই এ বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে নাগরিক আন্দোলন কমিটির বরিশাল জেলা সদস্য শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সিস্টেম সেই পূর্বের আদলেই চলছে। সেই পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা। নিত্য নতুন যানাবহনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই যানবাহন বাড়ার সাথে সাথে যানজট বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণের সময় এসে গেছে। তাছাড়া সমন্বয়হীনতার কারণেও যানজট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাদের যেই দায়িত্ব, তারা সেই দায়িত্ব পালন করছেন না। তাই যানজট নিরসনে বিকল্প ভাবনা ভাবার জন্যও আহ্বান জানান তিনি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আনিসুল করিম বলেন, ‘যানজট নিরসনের দায়িত্ব শুধুমাত্র ট্রাফিক বিভাগের একার নয়, এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই আমরা সমন্বয় করেই যানজট নিরসনে কাজ করছি। যাদের বিল্ডিংয়ে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই তাদের পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
আবার যারা নতুন বিল্ডিং করছেন তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হচ্ছে। যারা পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়া নতুন বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদন চাচ্ছেন তাদের নকশা অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া ট্রাফিক বিভাগও যানজট নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মূলত যানজট নিরসনের দায়িত্ব পুলিশের পেট্রোল টিমের। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের পেট্রোল টিম না থাকায় ট্রাফিক বিভাগ যানজট নিরসনের জন্য কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের পেট্রোল টিম অনুমোদন পাবে। সেই সাথে শহরের যানজট নিরসন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী ট্রাফিক বিভাগের এই কর্মকর্তা।
Leave a Reply