ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর সরকার দেশের সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি আমদানির যে উদ্যোগ নেয়, তার এক-চতুর্থাংশ ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে। তবে এর অধিকাংশই নিম্নমানের ও পচা। ফলে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে যেখানে পেঁয়াজের কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি করার কথা, সেখানে আমদানি করা ৫০ কেজি ওজনের প্রতিবস্তাই বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়! এতেও ক্রেতা পাচ্ছেন না আড়তদাররা। এ ছাড়া পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৪৫, পাকিস্তানি ৩২, তুরস্ক সাদা ২৮ ও লাল ৪২, মিসর ও চায়না ২৫, মিয়ানমার ৩৫, নিউজিল্যান্ড ৪০ এবং ইরানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকা দরে।
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের আড়ত আছে প্রায় ১৫০। গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিটি আড়তের সামনেই পচা পেঁয়াজের বস্তা। কোনো কোনো আড়তদার তো নামমাত্র মূল্যে অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ১০ টাকায় সেগুলো বিক্রি করছেন। আড়তদার আবু হানিফ আমাদের সময়কে বলেন, ‘পেঁয়াজ থেকে পানি ঝরছে। অঙ্কুরোদগম হচ্ছে, পচে যাচ্ছে। সেগুলো উল্টো ভালো পেঁয়াজকে নষ্ট করছে। আর এসব পচা পেঁয়াজের বস্তা কোথাও সরিয়ে নিতে হলে শ্রমিক ভাড়া করতে হবে। তাই আড়তের সামনে রাখছি, যার ইচ্ছা সে নিয়ে যাচ্ছেন।’ মোহাম্মদিয়া বাণিজ্যালয়ের সামনে কথা হয় ফুটপাতের কাঁচা পণ্য বিক্রেতা রশিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) চার বস্তা ৪০ টাকায় নিয়ে গিয়ে কোনোমতে ১৭ কেজির মতো পেয়েছি। যেগুলো ২৭ টাকা কেজিতে বিক্রি করি।’
হামিদ উল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংকটের সময় অনেকের মতো অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরাও অধিক মুনাফার আশায় পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। এমনকি লোহার ব্যাপারীরাও পেঁয়াজ এনেছে। ধারণা না থাকায় তাদের মাধ্যমেই এসেছে এসব নিম্নমানের পেঁয়াজ। দাম না পাওয়ায় সেগুলো এখন বস্তাতেই পচে যাচ্ছে। আর তাদের অজ্ঞতার কারণে লোকসানে পড়েছি আমরা আড়তদাররা।’
এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন গত মঙ্গলবার সকালে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে নগরীর চকবাজার ধুনিরপুল এলাকায় চাক্তাই খাল থেকে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার কার্যক্রম ও মশার ওষুধ ছিটানো পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন, ব্যবসায়ীরা পচা পেঁয়াজ ফেলে দিচ্ছেন খালে। এতে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী নামে এসব গণদুশমন মজুদদারদের প্রতিহত করতে হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গেল ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সমুদ্রবন্দর দিয়ে ২ লাখ ৬ হাজার ৭৮৮ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মিসর, পাকিস্তান, চীন, উজবেকিস্তান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসে মাত্র ৪৮ হাজার ৩৮৯ টন পেঁয়াজ, যা অনুমতিপত্রের মাত্র এক-চতুর্থাংশ। তার মধ্যেও রয়েছে গলদ, বন্দরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনটেইনার থেকে বের করার পর এসব পেঁয়াজ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে। বাজারে আসতে আসতে সেগুলো বস্তাতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে ফেলা দেওয়া হচ্ছে চাক্তাই খালে।
জারিফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের আমদানিকারক মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, ‘ঠিকভাবে ডেলিভারি না হওয়ায় মাল পচে যাচ্ছে। তার পর আবার জাহাজের মধ্যে তাপমাত্রার সমস্যা হচ্ছে। ২০ শতাংশ টাকাও উঠে আসবে না। কিছু কিছু পেঁয়াজ একদম ফেলে দিতে হচ্ছে, এক টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমদানি করা পেঁয়াজ যতটুকু আসছে, সেগুলো ভালো হলে দাম আপনাআপনিই কমে আসত। কিন্তু অধিকাংশই বন্দর থেকে ছাড় করার পর পচতে শুরু করায় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা লোকসান যাচ্ছে।’
বন্দরের সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক আসাদুজ্জামান বুলবুল আমাদের সময়কে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুমাস পেঁয়াজের আমদানি অনুমতিপত্র নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে শীত মৌসুম ঘনিয়ে আসায় এবং চাহিদা কমতে থাকায় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র গ্রহণের হার কমে গেছে। তাই নভেম্বর থেকে আর নতুন করে কেউ আইপি ইস্যু করেননি।’
Leave a Reply