একাত্তরের সংযোগে যা কিছু অর্জন এবং তার সূত্রে যা কিছু হয়েছে ও হয় সেগুলোর গুরুত্ব, তাৎপর্য বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন মাত্রা বহন করে। কিছু কিছু দিবস পালন গতানুগতিক হলেও একাত্তর সম্পর্কিত দিবসগুলো শুধু আবেগ-অনুভূতিতে ভিন্ন মাত্রার নয়, তার সব কিছু বর্তমানকে যেমন উজ্জ্বল করে, তেমনি ভবিষ্যৎ পথরেখা রচনায় অফুরন্ত রসদ জোগায় এবং বর্তমান প্রজন্মকে চেতনার শক্তিতে সমৃদ্ধ করে। অস্ত্র-সরঞ্জামাদি যতই আধুনিক হোক এবং কলেবর যতই বৃদ্ধি পাক, তার সঙ্গে চেতনার শক্তি না থাকলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হয় না। একাত্তরের যুদ্ধের মাঠ আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উজ্জ্বল উদাহরণ। একটি স্লোগান, রণ ধ্বনি—জয় বাংলা সমস্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ ও জনবলের শক্তির চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী ছিল বলেই আরো অন্তত ছয় মাস যুদ্ধ চালাবার সব রসদ ও অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ থাকার পরও একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা সদস্য অবনত মস্তকে প্রকাশ্য জনসমাবেশে সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়। সুতরাং ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস এলে নতুন প্রজন্মের সেনা সদস্যরা একাত্তরের দিকে ফিরে তাকিয়ে যদি নিজেদের সমৃদ্ধ করেন, তাহলে দিবস পালন গতানুগতিক না হয়ে গভীর তাৎপর্যময় হবে।
মুক্তিযুদ্ধের মাঠেই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী মনে-প্রাণে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তার মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর আত্মার ও রক্তের সম্পর্ক তৈরি হয়। বিগত ৪৯ বছরে সেই সম্পর্ক একই রকম ছিল না। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ একটা সময় গেছে, যখন সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রায় ১২ বছর ধরে জাতির পিতার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আত্মার সম্পর্কটি আবার তৈরি করে দিয়েছেন। এ বছরের সশস্ত্র বাহিনী অন্য একটি ভিন্ন মাত্রা বহন করছে। কারণ ২০২০ সাল মুজিববর্ষ, জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিটি অভিধা একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যার কেন্দ্রে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশকে পরিচালনার সুযোগ পান বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর আজীবনের স্বপ্ন একটা আধুনিক ও গর্ব করার মতো সশস্ত্র বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করে ব্রিগেড পর্যায়ে উন্নত করেন। সীমাহীন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সত্ত্বেও তিন বাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জামাদি আনেন এবং সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক—বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। মুজিববর্ষের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি কথার উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই, যেগুলো তিনি বলেন প্রথম বিএমএ (এসএসসি-১) শর্ট কোর্সের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। এই জন্য যে বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ। সে জন্যই সম্ভব হয়েছে আজ আমার নিজের মাটিতে একাডেমি করা। আমি আশা করি, ইনশা আল্লাহ এমন দিন আসবে, এই একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, সমস্ত দুনিয়ায় সম্মান অর্জন করবে।’
বঙ্গবন্ধুর এই আশা আজ তাঁর মেয়ের হাত ধরে পূর্ণ হয়েছে। আরেক জায়গায় তিনি বলেন, ‘মনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মেন্টালিটি না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, তোমরা বাংলাদেশের সৈনিক। গুরুজনকে মেনো, সৎ পথে থেকো, শৃঙ্খলা রেখো, তাহলে জীবনে মানুষ হতে পারবা।’ বঙ্গবন্ধুর এই উপদেশমূলক কথাগুলো যদি সব সেনা সদস্যের চলার পথের পাথেয় হয়, তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে আর কেউ কোনো দিন ভুল পথে নিতে এবং অপবাদ দিতে পারবে না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেন, যার কিছু কথা আজকের বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিধায় তার খানিকটা তুলে ধরছি। ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ বছর পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে যদি বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর ৩০ লাখ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই পারব, এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর আর মুনাফাখোরদের নির্মূল করতে হবে। কয়েকটি চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ পাচার করে দেয়। বাংলার বুক থেকে এদের উত্খাত করতে হবে। চোরের শক্তি বেশি, নাকি ঈমানদারের শক্তি বেশি সেটা প্রমাণ করে ছাড়ব।’ বঙ্গবন্ধুকে যদি অকালে চলে যেতে না হতো, তাহলে আজ আমাদের এই কথাগুলোর পুনরুল্লেখ করতে হতো না। আমরা আরো বড় স্বপ্নের কথা বলতাম। বাঙালির মেধা ও কল্পনাশক্তি কারো থেকে কম নয়। কিন্তু তার যথার্থ ব্যবহার হচ্ছে না।
পঁচাত্তরের পর দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় আর সুনামির তছনছ থেকে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সংগ্রাম চলছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১২ বছরে সশস্ত্র বাহিনী একটি আধুনিকতার সড়কে ওঠে এসেছে। তার ওপর একটু নজর বোলাই। কয়েকটি নতুন পদাতিক ডিভিশন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনেক ব্রিগেড ও ইউনিট গঠনসহ সেনাবাহিনীর সব শাখাকে শক্তিশালী করা হয়েছে, যাতে সার্বিক সক্ষমতার জায়গায় ঘাটতি না থাকে। ট্যাংক, সব ধরনের নতুন আর্টিলারি কামান, মিসাইল, স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থাসহ আধুনিক সব অস্ত্র-সরঞ্জামাদি সংযোজিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি নতুন সেনানিবাস হয়েছে। নৌবাহিনী এখন জল, স্থল, আকাশ, ত্রিমাত্রিক বাহিনীর রূপ নিয়েছে। নৌবাহিনীর ঘাঁটি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণসহ যোগ হয়েছে সাবমেরিন ও নতুন নতুন যুদ্ধজাহাজ। বিমানবাহিনীতে আধুনিক যুদ্ধবিমান, রাডার, পরিবহন বিমান এবং বহুমাত্রিক হেলিকপ্টার যোগ হয়েছে। ঘাঁটির সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সার্বিক কাঠামোগত পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। তিন বাহিনীর জন্য সব ধরনের আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং অফিসারদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে মনন, মেধা ও প্রজ্ঞার সম্প্রসারণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ।
জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা একই তালে বৃদ্ধি পাওয়া আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের নেতারা আজ মুখে শান্তির কথা বললেও সব দেশই পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদির ব্যবসা ও প্রতিযোগিতা গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় শক্তিগুলোর পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার বিশ্বশান্তির জন্য আজ বড় হুমকি। তা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই। অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও সামরিক শক্তির পেশি প্রদর্শন এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ফ্রন্টলাইন রাষ্ট্র হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্য আছে। আমাদের চারদিকের সব দেশই সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। বাংলাদেশের লাইফলাইন বঙ্গোপসাগর এবং তা লিংকেজ ভারত মহাসাগর আজ সামরিক দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের এই অঞ্চল ঘিরে বৃহৎ শক্তির চরম বিভাজন ও মেরুকরণ আজ স্পষ্ট। এর শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। তারপর চরম ডানপন্থী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শের রাজনীতি সব দেশেই যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাতে শান্তির আশা করা কঠিন এবং অবাস্তব চিন্তা। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য কঠিন সংকট তৈরি করেছে। জননিরাপত্তা ও দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার হুমকি আজ আর শুধু আশঙ্কা নয়, তার অনেক বাস্তব নিদর্শনও দেখা যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনীর কিছু ইউনিটের পতাকা উত্তোলন এবং নৌবাহিনীর নতুন যুদ্ধজাহাজের কমিশনিং অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু আক্রান্ত হলে তা প্রতিহত করার সক্ষমতা থাকতে হবে।’ এটাই সশস্ত্র বাহিনীর মিশন। এই মিশন সামনে রেখেই চলছে অগ্রায়ণের কার্যক্রম। কিন্তু লেখার শুরুতে যে কথাটি বলেছি, চেতনার শক্তির ওপরে কোনো শক্তি নেই। সেই শক্তির অফুরন্ত জায়গা আমাদের একাত্তর। তার সূত্রেই প্রতিবছর সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করা হয়। এই দিবস পালন সার্থক হবে যদি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও আদর্শ থেকে উৎসারিত চেতনাকে ধারণ এবং তার লালন-পালন করেন। মুজিববর্ষের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Leave a Reply