নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় শুধু বরিশালে পানিতে ডুবে মারা যায় তিন গুণেরও বেশি শিশু। প্রতি বছর বরিশাল বিভাগে ৩ হাজার ১৪৪ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রতিদিন গড়ে নয়জন শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে যা কিনা নীরব এক মহামারী। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্স বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীমাতৃক দেশে পানির সহজলভ্যতা সাঁতার না জানা শিশুদের প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ। বরিশাল বিভাগে মারা যাওয়া ৩ হাজার ১৪৪ জন শিশুর মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী ১ হাজার ৭৫০ জন এবং ১০ বছরের কম বয়সী ৫৪০ জন শিশু। প্রতিদিন বরিশাল বিভাগে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের ৯ জন শিশু মারা যায়। প্রতি মাসে এই অঞ্চলে ২৬২ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
সিআইপিআরবি’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বরিশালে প্রতি লাখে এক থেকে চার বছর বয়সী ৪৪৫ জন শিশু মারা যায়, যার মধ্যে ৩২৫ জন ছেলে ও ১২০ জন মেয়ে। পাঁচ থেকে নয় বয়সী ১৩০ জন শিশু মারা যায়, যার মধ্যে ৭৮ জন ছেলে ও ৫২ জন মেয়ে।এছাড়াও ১০ থেকে ১৪ বয়সী ৩৭ জন শিশু মারা যায়, যার মধ্যে ৯ জন ছেলে ও ২৮ জন মেয়ে। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে (২০১৬)এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে ১১ দশমিক ৭ ভাগ জন মানুষ। আর ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রির্সাচ,বাংলাদেশ- (সিআইপিআরবি)’র ভাসা প্রকল্পের আওতায় একটি পরিসংখ্যানে (অক্টোবর ২০১৬- ফেব্রুয়ারী ২০১৭ পর্যন্ত) দেখা গেছে,বরিশালের ৬ জেলাজুড়ে পানিতে ডুবে করুণ মৃত্যুর শিকার হচ্ছে প্রতি লাখে ৩৭ দমশিক ৯ ভাগ জন মানুষ। এর মধ্যে বরিশালে প্রতি বছরে ৩ হাজার ১৪৪ জন,প্রতি মাসে ২৬২ জন, দিনে ৯ আর প্রতি আড়াই ঘন্টায় ১ জন করে মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুও কোলে ঢলে পড়ছে। যা বাংলাদেশের বাকি বিভাগগুলোর তুলনায় ৩ গুনেরও বেশি। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রির্সাচ,বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)’র ভাসা প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে। প্রজেক্ট ভাসা’র টিম লীডার ডা. শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া ও বরগুনা জেলার তালতলী ও বেতাগী উপজেলায় শিশু মৃত্যুহার বেশি হওয়ায় সেখানে আমরা কাজ করছি।
বরিশাল বিভাগ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে অনেকগুলো বড় নদী একসাথে মিলিত হয়েছে। বরিশালের আয়তন প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা ৮০ লাখের অধিক। এই বিভাগটি দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এ বিভাগের ছয়টি জেলাই দুর্যোগপ্রবণ।’ শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের গ্রামাঞ্চলে সকাল নয়টা থেকে দুপুর ৩ টার মধ্যে পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে। বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা তখন মা গৃহস্থলীর কাজে, বাবা থাকে ক্ষেত-খামারে ব্যস্ত আর মায়ের অবর্তমানে অন্যদের তত্ত্বাবধানে অভাব কারণেই এ দুর্ঘটনার শিকার হয় শিশুরা। পানিতে ডোবার মৃত্যুর কমানোর লক্ষে প্রতিকার ও প্রতিরোধ হিসেবে ভাসা প্রকল্প বরিশালের কলাপাড়া, বেতাগী ও তালতলীর বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করছেন।’ ‘দিনের বেলায় কমিউনিটিতে আচঁল নামে শিশু যতœ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ কেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট কমিউনিটির শিশুদের কে এনে কর্মরত একজন আচঁল মা ও তার সহকারী একজন নারী সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ৩ টা প্রর্যন্ত মায়ের মত তার আচঁলের নিচে রেখে মায়া-মমতা আর বিভিন্ন খেলাধুলা এবং বিনোদনের মাধ্যমে যতœ নেন। এছাড়াও আমরা কমিউনিটিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উঠান বৈঠক, অভিভাবক সভা, স্কুলে সচেতনা, শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।’ শিশু স্বাস্থ্য গবেষকরা মনে করেন, সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে হলে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে হবে। প্রতিবছর যে সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে তাতে এমডিজি অর্জনের গতি কমে যাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্স বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) পরিচালক ডা. আমিনুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশের শিশু মৃত্যুর মধ্যে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু একটি অন্যতম বড় কারণ। সারা বিশ্বেই এক বছর থেকে চার বছরের শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, তারপর পাঁচ থেকে নয় বছরের শিশুরা।আমাদের দেশেও একই সমস্যা রয়েছে।’ পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ‘সিআইপিআরবি’ বেশ কিছু কাজ করা হচ্ছে বলেও জানায় সংস্থাটি। তারা জানায়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে তারা আঁচল, ভাসা (ফ্লোটিং), সিসেফ নামের বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
ডা. আমিনুর রহমান বলেন, আমরা ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) করে সুফল পেয়েছি। আঁচল ১০ হাজার শিশুর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। এবং ৩০ হাজার শিশুকে সাঁতার ও উদ্ধার কাজ শিখিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নিলে মৃত্যু হার কমানো আরও সম্ভব হবে।’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন বর্ষাকালে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটে; ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নদীমাতৃক দেশের বন্যাপ্রবণ এলাকায় পানিতে ডুবে যে শিশুর মৃত্যু ঘটে, এটা ঠিক। মৃত্যুহার কমাতে আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি রয়েছে।
Leave a Reply