রাজাপুর প্রতিনিধি ॥ ঝালকাঠির রাজাপুরের ধানসিঁড়ি নদী খননকৃত উর্বর পলি মাটিতে নদীর দুই তীরে নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ। উর্বর পলি মাটিতে বিভিন্ন জাতের সবুজ ফসল বিপ্লবের হাতছানি দিচ্ছে। বিভিন্ন জাতের সবুজ গাছপালার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলতানে মুখরিত নদীটির দুই তীর। রাতের দৃশ্য আরও মনকাড়া। ডুমুর গাছে জোনাকি পোকার জ¦লজ¦ল আলোতে নদীর দুই তীর আলোকিত হয়ে যায়। যে কোনো মানুষের চোখ আটকে যাবে জোনাকি পোকার আলোর টিপ টিপ তালে। উপজেলায় একমাত্র পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে হাতছানি দিয়ে ডাকছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। সংশ্লিষ্টদের একটু নজরে এলেই দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার নদী ‘ধানসিঁড়ি’। কারণ নদী, পানির কুলকুল শব্দ, সবুজ, পাখপাখালির কলতান ও বাহারি সবুজ রঙের বিভিন্ন ফসল কার না ভালো লাগে। স্থানীয় গাছিরা নদীর দুই তীরের খেজুর গাছ রস সংগ্রহের জন্য পরিষ্কার করে কেটে খিল লাগিয়ে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সেই বাঁশের কঞ্চির খিলে বসে পাখিদের খেজুর গাছের রস খাওয়ার দৃশ্য আরও আকর্ষণীয়। পাখির কিচিরমিচির সুরেলা ডাকে মন হারিয়ে যায় আচেনা দেশে। বন বিভাগ জানান, নদীটির ১২ কিলোমিটর তীরজুড়ে ঝালকাঠি সদর ও রাজাপুর উপজেলা বন বিভাগ সারিবদ্ধভাবে রোপণ করেছে রেইনট্রি, মেহগনি, আকাশমনি, শিশু, জারুল, বকাইন, কাঠ বাদাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম্বুরা, আমলকী, বহেরা, অর্জুন, অরহর, ডুমুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তা ছাড়া স্থানীয় ৪ শতাধিক কৃষকরা নদীটির দুই তীরে শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উর্বর পলি মাটিতে যা-ই চাষ করা হয়, তা-ই ফলছে। কৃষকরাও এ উর্বর মাটির জাদুতে মনের আনন্দে চাষ করছেন। নদীতীরে উপজেলা বন বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকরা বিভিন্ন সবুজ গাছপালা ও ফসলের চাষ করায় পুরো নদীই সবুজের আবর্তে ডুবে আছে। অনেক সময় ভয়ও লাগে এ সবুজ গাছগাছালির মধ্যে। কিন্তু কোথাও কোনো ভয়ানক প্রাণী বা জীব-জন্তুর দেখা নেই। যেসব সবুজ প্রকৃতিপ্রেমী সবুজকে ভালোবাসেন, তারা এখনই নিজ চোখে দেখে যান চির সবুজ দেশের আসল সবুজ। যেভাবে যাবেন ধানসিঁড়ির তীরে : পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে সহজ কয়েকটি পথ হলো রাজাপুর উপজেলার বারৈবাড়ি থেকে পূর্বদিকের রাস্তাটি দিয়ে সহজেই নদীতীরে পৌঁছা যায়। এ রাস্তায় সামনে রয়েছে নদী খননের ভিত্তিপ্রস্তুর। এ ছাড়া পিংরি স্কুল এলাকা থেকে নদীতীরে যাওয়ার দুটি পথ রয়েছে। কয়েক কদম হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন নদীতীরে। তা ছাড়া উত্তর বাগড়ি, বাঁশতলা, বাগড়ি বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ধানসিঁড়ি নদীতীরে যাওয়া যায়। যখন খুশি ঘুরে আসুন প্রকৃতির লীলাভূমি ধানসিঁড়ি নদীর সবুজ তীর। মৌসুমি ও স্থায়ী স্থানীয় কৃষকরা নদীর দুই তীরের উর্বর মাটিতে আর্থিক মুনাফা লাভের আশায় চাষ করেছেন আলু, সরিষা, টমেটো, শিম, লাউ, কুমড়া, মুগডাল, লালশাক, মুলা, সুস্বাদু ক্ষীরা ইত্যাদি। কৃষকরা ভালো ফলনে বেশ খুশি। স্থানীয় একাধিক কৃষকারা জানান, প্রায় দীর্ঘ সাত কিলোমিটার নদীর ২ তীর জুড়ে প্রায় ১২টি গ্রামের ৪ শতাধিক কৃষক বিভিন্ন প্রকার কৃষি চাষ করেছেন। এর মধ্যে পেশদারি কৃষক রয়েছেন দুইশতাধিক এবং দুই শতাধিক রয়েছেন মৌসুমি কৃষক। কৃষকরা নিজেদের চহিদা মিটিয়ে অবশিষ্ট কৃষি ফসল উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি করে অধিক মুনফা পেয়ে বেশ খুশি। পিংরি গ্রামের কৃষক আকব্বর মৃধা জানান, ধানসিঁড়ি নদী তীরে তার প্রায় ৪০ শতাংশ জমি রয়েছে। এতে শালগম, পেপে, ধনিয়া, লালশাক, মুলা, লাউ ও মিষ্টি কুমড়াসহ একাধিক সাথী ফসল চাষ করেছেন। ৪০ শতাংশ জমিতে খরচ হয়েছে প্রায় দশ হাজার টাকা। তাতে যে ফসল হয়েছে তা দিয়ে নিজের চাহিদা মেটানোর পরে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা পাবে বলে তিনি আশা করছেন তিনি। একই গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম, রিয়ান সিকদার, দেলোয়ার কারিকর, মোয়াজ্জেম মৃধা ও উজ্জ্বল মৃধা জানান, ধানসিঁড়ি নদীর মাটি খনন করায় পলি মাটিতে কৃষির ফলন ভালো হওয়ায় নদীর দুই পাড়ে এলাকার প্রায় দুই শতাধিক পেশাদার ও দুই শতাধিক মৌসুমি কৃষক দীর্ঘ প্রায় ৭ কিলেমিটার জুড়ে কৃষি চাজ করছেন। এলাকার ফিরোজ আলম মৃধা জানান, খুলনার একটি মিলে চাকরি করতেন। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকায় এসে ওই স্থানে কৃষি ফলন ভালো দেখে তিনিও কৃষি কাজ করছেন। কৃষকরা আরও জানান, নদীর দুই ধারে সাত কিলোমিটার এলাকায় মিষ্টি আলু, টমেটো, সিম, সড়িষা, পুঁইশাক, পেয়াজ, গোল আলু, লাফা, মরমা, শালগম, পেপে, ধনিয়া, লালশাক, মুলা লাউ ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করা হয়েছে। এতে প্রত্যেক কৃষক খরচের দেড় থেকে দ্বিগুন মুনফা পাবেন বলে তারা আশা করছেন। ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, প্রধানমন্ত্রীর ডেলটা প্লান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরস্ত ছোট নদী খাল খনন প্রকল্পের আওতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঝালকাঠি জেলার ধানসিঁড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২ বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ ঐতিহ্যবাহী নদীটির ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে খনন কাজ শুরু করে রাজাপুর উপজেলার বাগড়ি বাজারের জাঙ্গারিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে নদীটির ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮০৬.৫ ঘ. মি. মাটি খনন করা হচ্ছে। প্রকল্পের শর্তানুযায়ী নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে পাড় থেকে দুরে রাখতে হবে এবং বতর্মান নদীর তীর বা চর/সমতল থেকে নদীর গভীরতা হতে হবে সাড়ে ১৫ ফুট (৪.৭ মিটার) এবং উপরের প্রস্থ্য প্রায় ৭০ ফুট এবং গভীর/তলদেশে প্রস্থ ২০ ফুট। এ কাজের জন্য মনোনিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার পুরানা পল্টনের আরএবি-পিসি (প্রাঃ) লিঃ-পিটিএসএল ও মৈত্রী (প্রাঃ) লিঃ কে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ প্রদান করেন এবং চলতি বছরের ১২ মার্চ কাজ শুরু এবং ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল সম্পন্ন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীটি সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরেও প্রায় ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে রাজাপুর অংশের পিংড়ি-বাগড়ি-বাঁশতলার মোহনা পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার খনন করেছিল। রূপসী বালার কবি জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে তার কবিতায় লিখেছিলেন, আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে….। এ কবিতাটির মাধ্যমে বিশ^জুড়ে এ ধানসিঁড়ি নদীটি ব্যাপক আলোচিত হয়। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রিয়াজ উল্লাহ বাহাদুর জানান, ধানসিঁড়ি নদীটির খননকৃত পলিমাটি বেশ উর্বর। শাক সবজি চাষের জন্য একদম যথাযথ। যে কারণে বিভিন্ন সবজি ও শাক ব্যাপক হারে ফলছে। কৃষকদের সার ও বীজ প্রনোদনা এবং পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন খান জানান, দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের আওতায় ২০১১-১২ অর্থবছরে সিড রিং ৫ কিলোমিটার নদীর দুই তীরজুড়ে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হয়েছে। সদর উপজেলার আওতার ৭ কিলোমিটারেও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। ফলে দুই তীরজুড়ে নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ বিরাজ করছে। রাজাপুর ও ঝালকাঠির আওতার ১২ কিলোমিটার ছাড়াও নদীতীরের অনেক জমি রয়েছে, যাতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা রোপণ করা যাবে।
Leave a Reply